ভরা বর্ষায় ইলিশের আকাল। তাই বাঙালির পাত ভরলেও মন ভরছে না। রসনার সেই অতৃপ্তি কাটাতে এখন সুখবর বহু দিন আগে হাতের বাইরে চলে যাওয়া ‘দুর্মূল্য’ চিংড়ি আবার ‘সুলভ’ হয়ে ফিরে এসেছে নাগালের মধ্যে। সৌজন্য: রফতানিতে মন্দা।
সত্তরের দশক ইস্তক জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বিপুল হারে পশ্চিমবঙ্গের চিংড়ি আমদানি করছে। বিদেশের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ভাল, বড় চিংড়ি কার্যত নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল আম-গেরস্তের হেঁসেল থেকে। কিন্তু রফতানিতে ভাটার টানে ছবিটা বদলেছে। একদা ‘দূর থেকে দেখার’ ছ’শো-সাতশো টাকার দুর্লভ বাগদা-চাপড়া এখন দু’শো-আড়াইশো-তিনশোয় দেদার বিকোচ্ছে রাজ্যের বাজারে-বাজারে! এমনকী, নিউ মার্কেট-গড়িয়াহাটের মতো অভিজাত বাজারে ক’দিন আগেও হাজার টাকা পেরোনো অতিকায় বাগদা এখন মিলছে সাড়ে চারশো-পাঁচশোয়! ডলার-ইউরোধারী সাহেবসুবোর প্লেটের বদলে তা উঠছে গিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালিরই পাতে। |
পশ্চিমবঙ্গে সাধারণত তিন জাতের চিংড়ির চাষ হয় বাগদা, গলদা ও চাপড়া। আন্তর্জাতিক বাজারে বাগদা-চাপড়ার কদর সবচেয়ে বেশি। বিদেশের চাহিদা মেটাতে গিয়ে রাজ্যে চিংড়ি উৎপাদনও দিন দিন বেড়েছে। এখন রফতানি মার খাওয়ায় সেই উৎপাদন ‘বাড়তি’ হয়ে যাচ্ছে, ফলে ইদানীং খুচরো বাজারেও বাগদা-চাপড়ার ‘ঢল’ নেমেছে। চিংড়ি এমনই জিনিস, যা তিন-চার মাসের বেশি জলে রাখা যায় না। আবার জল থেকে তুলে তা সংরক্ষণেরও বিস্তর হ্যাপা ও খরচ, যেটা শুধুমাত্র রফতানির ক্ষেত্রেই করা হয়। রফতানি নেমে যাওয়ায় চিংড়ি-চাষিরা অগত্যা ‘জলের দরেই’ স্থানীয় বাজারে মাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানালেন সামুদ্রিক খাদ্য রফতানিকারীদের সংগঠন ‘সি ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য শাখার সভাপতি তাজ মহম্মদ।
রফতানি কমলো কেন?
এ জন্য কয়েকটি কারণকে দায়ী করছেন রফতানিকারীরা। তাঁদের বক্তব্য, পরিস্থিতি প্রতিকূল হতে শুরু করেছিল ২০০৪-এ। মার্কিন উৎপাদকদের চাপে পড়ে ওয়াশিংটন চিংড়ি আমদানির উপরে বাড়তি শুল্ক বসায়। ফলে আমেরিকায় চিংড়ি রফতানি মার খায়। তার পরে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার ধাক্কা ও ডলার-মূল্যে ঘন ঘন উত্থান-পতন। চিংড়ি রফতানিতে ওই অনিশ্চয়তার ছায়া পড়েছে। আবার জাপান, ইউরোপ ও মার্কিন মুলুকের বাজারে ইদানীং চিংড়ির দাম পড়তির দিকে। পাশাপাশি চিংড়ি রফতানির বাজারে সম্প্রতি বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার মতো কিছু দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মুখেও পড়তে হচ্ছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের।
“আর এ সব মিলিয়েই পশ্চিমবঙ্গ থেকে রফতানির বহর কমে গিয়েছে। এ দিকে উৎপাদনে কমতি নেই। তাই বাজারে হঠাৎ প্রচুর চিংড়ি উঠেছে। দামও বেশ কম।” বলছেন তাজ।
বস্তুত চার দশক আগে চিংড়ি রফতানির হিড়িক পড়ার পরে যত দিন গড়িয়েছে, বিদেশিদের রসনা তৃপ্ত করতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তত বেশি বেশি চিংড়ি সাগড়পাড়ি দিয়েছে। স্বভাবতই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে উৎপাদন। দুই ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উপকূলবর্তী এলাকার যে ৪৮ হাজার হেক্টর জুড়ে অসংখ্য ভেড়িতে নোনা জলের মাছের চাষ হচ্ছে, তার প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টরই চিংড়ির জন্য বরাদ্দ। তাজ মহম্মদের হিসেবে, সত্তরের দশকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বছরে গড়ে আড়াই কোটি টাকার চিংড়ি বিদেশে যেত। আশির দশকে অঙ্কটা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ কোটিতে। বিগত দশকে তা প্রায় বারশো কোটিতে ঠেকেছে। চিংড়ি বিদেশে যায় মাথা বাদ দিয়ে। রফতানিযোগ্য এক কেজি চিংড়ির মাথা বাদে ওজন দাঁড়ায় মোটামুটি ৬৩০ গ্রাম। হিমঘরে শূন্যেরও ৪০ ডিগ্রি কম তাপমাত্রায় জমাট বাঁধিয়ে সেই চিংড়ি জাহাজে তোলা হয়।
ব্যবসায়ী মহলের তথ্যে আরও জানা যাচ্ছে, বছরে এ রাজ্যে প্রায় ৩০ হাজার টন চিংড়ি উৎপাদন হয়। এর অন্তত ২০ হাজার টন ওঠে কাঁথি অঞ্চলে। যদিও তাজ মহম্মদের দাবি, খদ্দেরের পছন্দের তুলমূল্য বিচারে দুই ২৪ পরগনার চিংড়িই হয়তো একটু এগিয়ে থাকবে। কেন?
চিংড়ি-চাষি ও ব্যবসায়ী মহলের মতে, কারণটা লুকিয়ে আছে উৎপাদন-পদ্ধতির মধ্যে। দুই ২৪ পরগনায় এখনও চিংড়ি চাষ হয় মূলত সাবেক পথে, রাসায়নিকবিহীন সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার ভেড়ি-মালিক কমল ঘোষ বলেন, “আমরা পুরো চাষটাই করি সর্ষে খোল দিয়ে। চিংড়ির ভেড়ি তৈরির সময়েই খোল দেওয়া হয়। সেটাই চিংড়ির স্বাভাবিক খাদ্য। শ্যাওলাও চিংড়ির ভাল খাদ্য।” এবং এই প্রাকৃতিক খাদ্যে পুষ্ট চিংড়ির স্বাদ অনেক বেশি বলে কমলবাবুর দাবি। কাঁথি-হলদিয়া চিংড়ির সঙ্গে এর ফারাকটা কোথায়?
উৎপাদকমহলের ব্যাখ্যা, ওখানে চিংড়ি ফলানো হয় আধুনিক ‘আধা-নিবিড়’ পদ্ধতিতে, যাতে রাসায়নিকের ভূমিকা যথেষ্ট। খোল-শ্যাওলার মতো প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিবর্তে চিংড়ির পোনাকে দেওয়া হয় ভিটামিন-প্রোটিনসমৃদ্ধ কৃত্রিম খাবার। তাতে ফলন বিস্তর হলেও স্বাদ তত খোলে না বলে জানিয়েছেন চাষিদের অনেকে। তাঁদের এক জনের কথায়, “দেশি মুরগির সঙ্গে ব্রয়লারের স্বাদ যেমন মেলে না, চিংড়ির বেলাতেও তা-ই।” আধা-নিবিড় পদ্ধতিটি খরচসাপেক্ষও বটে।
কী রকম? কাঁথির চিংড়ি-চাষি স্বপন প্রামাণিক জানালেন, ধানি জমি লিজ নিয়ে প্রথমে সেখানে নদীর জল ঢোকানো হয়। ব্লিচিং দিয়ে শোধন করার পরে তাতে মেশানো হয় বিবিধ রাসায়নিক। সেই পরিশোধিত জলে ছাড়া হয় অন্ধ্র থেকে আনা চিংড়ির পোনা (মিন)। জলে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখতে যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখতে হয়। পোনার খাবারের দাম প্রায় ৭০ টাকা কেজি। সব মিলিয়ে এক কেজি চিংড়ি ‘ওঠাতে’ তাঁদের অন্তত ২১০ টাকা পড়ে যায় বলে স্বপনবাবুর দাবি। তিনি বলেন, “রফতানি ছাড়া এই খরচ তোলা অসম্ভব। আমাদের পুরো চাষটাই হয় বিদেশি বাজারের কথা মাথায় রেখে।”
রফতানিতে মন্দা দেখা দেওয়ায় তাই স্বপনবাবুরা প্রমাদ গুনছেন। রফতানি না-হলে ব্যয়বহুল সংরক্ষণের প্রশ্ন নেই। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা চিংড়ি সস্তায় ছেড়ে দিচ্ছেন স্থানীয় বাজারে। “কিন্তু এই লোকসান কত দিন টানব? এমন চলতে থাকলে বহু চাষি তো ব্যাঙ্কের ধার-ই শুধতে পারবেন না!” বলছেন তিনি। তাজ মহম্মদ অবশ্য আশাবাদী। ওঁর বক্তব্য: রফতানিতে এই ভাটা নেহাতই সাময়িক, অচিরে ছবিটা পাল্টে যাবে। “আন্তর্জাতিক বাজার দ্রুত বদলাচ্ছে। চাহিদা আবার বাড়বে। উপরন্তু আমদানিকারীরা এখন প্যাকেজিংয়ে বৈচিত্র চাইছে। রফতানির বাজার চাঙ্গা করতে হলে এটাও খেয়াল রাখা জরুরি।” বলেন তিনি।
তবে চিংড়ি-যাত্রায় এই সাময়িক বিচ্যুতির সুবাদেই মুখবদল হচ্ছে আম-বাঙালির।
|
নাগালে বাগদা |
মানিকতলা |
৩০০(কেজি’তে৩০টি) |
নিউমার্কেট |
৪৫০(কেজি’তে১৫টি) |
গড়িয়াহাট |
৪৫০(কেজি’তে২২টি) |
সল্টলেকএফডি |
২৫০(কেজি’তে৩০টি) |
* বৃহস্পতিবারের কেজিপিছু দর, টাকায়। |
|