এক দিকে তৈরি হচ্ছে খাদির পোশাক। সেই ধুতি-পাঞ্জাবি, চাদর, পর্দার কাপড় কিনতে কাউন্টারে ভিড়। অন্য দিকে ঘানিতে ভাঙা হচ্ছে সর্ষের তেল। সামনে গেলে ঝাঁঝে চোখ জ্বলে। খাঁটি তেলেরও খরিদ্দার কম নয়। আবার কোথাও কাগজকল থেকে বেরিয়ে আসছে নানা ধরনের কাগজ। পুরো এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে মিষ্টি সুবাস। ধুপকাঠিও বানানো হচ্ছে যে!
এ দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ২০০৬-এর ১৪ অগস্ট। বিরাটির অভয় আশ্রমে। ফি বছরের মতো সে দিনও আশ্রমকর্মীরা মহা উৎসাহে ঝকঝকে করে সাজিয়ে রেখেছিলেন গাঁধীজির ফোটোগ্রাফটি। যে ছবিতে অভয় আশ্রমের কর্মকাণ্ডের মধ্যে তিনি দাঁড়িয়ে। অধুনা মুমূর্ষু আশ্রমটিতে বিগত দিনের সেই কর্মচঞ্চল ছবিটাই ফিরিয়ে আনার নতুন একটা চেষ্টা চলছে। যে কারণে আগামিকাল, বৃহস্পতিবার মহাকরণে রাজ্য সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন কেন্দ্রীয় খাদি কমিশনের কর্তারা। এমনকী, অভয় আশ্রম পুনরুজ্জীবনে ‘পিপিপি’ মডেলে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের কথাও ভাবা হতে পারে বলে কমিশন-সূত্রের খবর।
আশ্রমের ছবিটা তো ছ’বছরে সত্যিই বিলকুল বদলে গিয়েছে! |
একদা কর্মমুখর আশ্রম চত্বর জুড়ে এখন যা ছড়ানো, তা শুধু অতীতের বিষণ্ণ ছায়া। চারদিক নিস্তব্ধ। গোটা জায়গাটা ভরে গিয়েছে ঝোপঝাড়ে। তার মধ্যে সাপ-ভামের আড্ডা। ঘানি-চরকা-তাঁত গতি হারিয়েছে বহু দিন, কাগজকল আর ধুপকাঠির কারখানাও স্তব্ধ। একতলার একটা ঘরে দেখা মিলল কয়েক জন কর্মীর। স্রেফ অভ্যেসের বশে হাজিরা দিতে এসেছেন। তাঁরাই জানালেন, সন্ধের পরে এ তল্লাটে পা রাখা মুশকিল। কারণ আঁধার ঘনালেই পুরো চত্বর সমাজবিরোধীদের পান-ভোজন-ফুর্তি আর মাদক সেবনের নিশ্চিন্ত ঠেক হয়ে ওঠে।
গাঁধীজি-দেশবন্ধু-নেতাজির সাধের অভয় আশ্রমের হাল এখন এমনই। চার বছর যাবৎ কাজ বন্ধ। দেড় বছর হল, ৫০ জন কর্মীর বেতনও বন্ধ। অভাবের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে তাঁদের কয়েক জন ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন। অন্যরাও আশার কোনও আলো দেখছেন না। শুধু স্মৃতিটুকু আঁকড়ে রয়েছেন। ওঁদের এক জন, প্রভাস পাল আশ্রমের অফিসঘরে বসে বললেন, “মাইনে পাই না। তা-ও অভ্যাসমতো রোজ আসি। বসে থাকি।”
কলকাতা-সহ রাজ্যের দশটি জায়গায় চল্লিশ বিঘে জমি-সহ আশ্রমের কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার এই বিরাটিতে মূল কেন্দ্র। এ জেলারই গাইঘাটা-বনগাঁ, নদিয়ার চাকদহ, বীরভুমের বাসুর, বাঁকুড়ার সোনামুখী-বিহারজুরিয়া-বাহারমুনি-বাঁকুড়া শহর এবং মালদহের বিরামপুরে আরও ৯টি উৎপাদন ইউনিট। সব বন্ধ। ট্রাস্টি মালিকানারপ্রতিষ্ঠানটি ক্রমশ রুগ্ণ হয়ে পড়ায় ১৯৮১-তে কেন্দ্রীয় খাদি ও গ্রামোদ্যোগ কমিশন এর দায়িত্ব নেয়। তার পরে লাভ-ক্ষতির টানাটানির মধ্য দিয়ে ক’বছর চলেছিল। ২০০৮ থেকে পুরোপুরি বন্ধ। প্রভাসবাবুর পাশে বসা বৃদ্ধা মনীষা চৌধুরীর আক্ষেপ, “এই অফিসেই কত বড় বড় মানুষকে কাছ থেকে দেখেছি! অভয় আশ্রম ছিল ওঁদের স্বপ্ন। সব নষ্ট হয়ে গেল!”
স্বপ্নের আশ্রমকে বাঁচাতে কর্মীরা অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। তবে তা নিষ্ফলা গিয়েছে বলে অভিযোগ। “এখানে হস্তশিল্প, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজকর্ম ছাড়াও নতুন বহু কিছু করার সম্ভাবনা রয়েছে। সে দিকে কারও নজরই নেই! কত জায়গায় ছুটলাম। কিছুই হল না!” স্বগতোক্তি কৃষ্ণ দত্তের। প্রভাসবাবু-কৃষ্ণবাবুর মতো কর্মীরা তাই এখন হাল ছেড়েছেন।
কিন্তু শতাব্দী-প্রাচীন প্রতিষ্ঠানকে জিইয়ে তুলতে রাজ্য সরকারের কিছু করার নেই? কেন্দ্রই বা হাত গুটিয়ে বসে কেন? |
সরকারি সূত্রের দাবি: অভয় আশ্রম ফের চালু করতে রাজ্য সরকার এখন উদ্যোগী হয়েছে। এ ব্যাপারে রাজ্যের কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া আগামী কাল, বৃহস্পতিবার মহাকরণে বৈঠক ডেকেছেন। বৈঠকে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় খাদি কমিশনের আধিকারিকেরা থাকবেন। এত দিন কিছু হয়নি কেন?
মানসবাবুর ব্যাখ্যা, “আমি দফতরের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে চেষ্টা চালাচ্ছি। কেন্দ্রীয় খাদি কমিশনের কর্তাদের সঙ্গেও কয়েক বার কথা বলেছি। খাদি কমিশন চাইছে, রাজ্য সরকার আশ্রমের দায়িত্ব নিক। যদিও তারা আশ্রমের জমি-সম্পত্তির অধিকার রাজ্যের হাতে ছাড়তে চায় না।
তাই মীমাংসার জন্য বৃহস্পতিবার ওদের আলোচনায় ডাকা হয়েছে।” কেন্দ্রীয় খাদি কমিশনের রাজ্য-অধিকর্তা রঞ্জিত সাহা বলেন, “বৈঠকে আশ্রম খোলার ব্যাপারে আলোচনা হবে।” কমিশন-সূত্রের ইঙ্গিত, বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে রাজ্য সরকার অভয় আশ্রম চালু করুক এটাই কেন্দ্রের ইচ্ছে। এবং সে ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের ‘পিপিপি’ (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মডেলে কোনও প্রকল্পের প্রস্তাবও দেওয়া হতে পারে।
সরকারি তরফে আশ্রম চালুর চেষ্টা অবশ্য আগেও হয়েছে। এক সময় রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প দফতর অভয় আশ্রম পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেছিল। তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত জানিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন ভাবে গড়ে তুলতে আড়াই কোটি টাকা দেওয়া হবে। এক বার রাজ্য খাদি বোর্ডও আশ্রমের ভার নিতে চেয়েছিল। কোনওটাই বাস্তবায়িত হয়নি।
সরকারের নতুন উদ্যোগের কথা শুনে তাই আর বিশেষ উৎসাহিত হন না দেড় বছর বেতন-বঞ্চিত প্রভাস পাল, কৃষ্ণ দত্তেরা। মহাকরণে কালকের বৈঠক ওঁদের নির্লিপ্তি কাটাতে পারে কি না, সেটাই দেখার। |