কবেকার ঝুরঝুরে কিছু খবরের কাগজের কাটিং আর আবছা হলদেটে ফটোগ্রাফ। সাদা পোশাকের লম্বাটে একটা চেহারা তাতে কোনও মতে বোঝা যাচ্ছে। দৌড় শুরুর মুহূর্তে সাইকেলে ঝুঁকে একরোখা এক বিনুনিধারী।
এর পাশে হাল আমলের কাগজের প্রথম পাতায় মেরি কমের মুষ্টিবদ্ধ হাত। মুছে যাওয়া অতীত থেকে চোখ সরিয়ে চকিত ‘জাম্প কাটে’ বর্তমানে বুঁদ হচ্ছেন মফস্সল শহরের এক বৃদ্ধা। “দুই বাচ্চার মাকে (মেরি) তেড়ে ঘুষি মারতে দেখি আর মনে হয়, মেয়েদের নিয়ে একঘেয়ে ভাবনার ছকটাই খান খান হচ্ছে।”
মঙ্গলবার দুপুরে হুগলির জগু দাস পাড়া লেনের বাড়িতে জানলায় ঠেস দিয়ে বসে নিজের মনেই বলছিলেন চিত্রা সেনগুপ্ত। শুধু নিজের নয়, গোটা একটা সময়ের কণ্ঠস্বর তিনি। চল্লিশের দশকের কলকাতায় সাইকেলে টালা থেকে টালিগঞ্জ কাঁপানো প্রমীলা-ব্রিগেডের অন্যতম ‘পান্ডা’। ৮২ বছরে কোমর ভেঙে এখন কার্যত শয্যাশায়ী। “অলিম্পিকে রুপো জেতা ডাকাবুকো মেয়েটার সঙ্গে আমার কীসের তুলনা! কিন্তু মেরি পেরেছে দেখে মনে হচ্ছে, এত দিনে আমি বা আমরাই করে দেখালাম!”
সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে সে-কালে বাঙালি মেয়েদের খেলাধুলোর নামী প্রতিষ্ঠান ছিল ‘শিশুমঙ্গল’। ‘মাস্টারমশাই’ নবীন সেন। ‘কোচ’ শব্দটার তখন চল হয়নি। হার্ডলার অমিয়া দত্ত, সাঁতারু সান্ত্বনা বসু, সাইক্লিস্ট তপতী মিত্র-পদ্মা দত্ত-চিত্রা সেনগুপ্তরা তাঁরই হাতে তৈরি। কলকাতার রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত সমাজে মূর্তিমান ব্যতিক্রম সেই মেয়েরা। চিত্রাদের ক্লাব থেকেই অ্যাথলেটিক্সে ’৫২-র হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে গিয়েছিলেন নীলিমা ঘোষ। আর চিত্রা? “১৯৫২ সালে আমি মোটে ২১-২২। খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু তত দিনে খেলাধুলো থেকে পুরো ছিটকে গিয়েছি।”
এক সময় মুচিপাড়ার শশিভূষণ দে স্ট্রিটের বাড়ি থেকে সঙ্গিনীদের নিয়ে সাইকেলে ছুট দিতেন দক্ষিণেশ্বর মন্দির পর্যন্ত। রোজ কাকভোরে অনুশীলন হতো ময়দানের পুলিশ মাঠে। সাইকেল নিয়ে বেরোনোর ‘অপরাধে’ কত বার ছেলেদের ঢিল পিঠে পড়েছে। “মা নিজেও বা কম ডানপিটে কীসে?” প্রশ্ন ছোড়েন চিত্রার পুত্রবধূ নীপা। “দক্ষিণেশ্বরের রাস্তায় এক বার এক দল ছেলে সাইকেলে যেতে যেতে বাজে কথা বলছিল। রেগে গিয়ে পিছনের চাকায় এমন মোচড় দিই, এক জন সঙ্গে সঙ্গে কুপোকাত!” সহাস্যে বললেন বৃদ্ধা। |
১৯৪৫ সালের টালা পার্কের মাঠে চিত্রার সেই ‘রূপকথা’র সাইক্লিংয়ের কিছু সাক্ষ্য মিলবে ধূসর কাগুজে নথিতে। দিনভর সাইক্লিংয়ের আসরে সামিল হয়েছিলেন দেশের বেশ কয়েক জন বাঘা সাইক্লিস্ট। মেয়েদের মধ্যে সাইক্লিংয়ে তখন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এডনা জনসন, এসথার লীলা, টি ম্যাকলিনদেরই একচেটিয়া দাপট। আর সাইকেল চালানো দূরের কথা, শাড়ির বদলে অন্য পোশাকে বেরোলেই তুমুল ‘দুয়ো’ শুনতে হয় বছর পনেরো-ষোলোর বাঙালি কিশোরীদের। এর মধ্যে চিত্রার সাইকেলটাও বিগড়ে গেল। রেঞ্জার্স ক্লাবের এক সাহেব সাইক্লিস্টের সাইকেল ধার নিয়ে আসরে নামলেন তিনি। সব বাধা উড়িয়ে দূর ও স্বল্প পাল্লার ইভেন্টে চিত্রার জয়জয়কার সে-দিন অনেকের নজর কেড়েছিল।
সাইকেলের চাকায় সেই দামাল দিনগুলো অবশ্য পলকেই ফুরিয়ে যাবে। প্রথমে পারিবারিক বিপর্যয়, তার পর সংসারের জাঁতাকলে পড়া বঙ্গললনার চিরকেলে কাহিনি জায়গা দখল করবে। স্বাধীনতার বছর সেটা। বাংলার শিক্ষক তথা লেখক, রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য প্যারীমোহন সেনগুপ্ত ও উমাদেবীর কন্যা চিত্রা মাত্র ২২ দিনের ব্যবধানে মা-বাবা দু’জনকেই হারালেন। খেলাধুলোর ‘বিলাসিতা’ ঘুচে গেল তখনই। ছোট-ছোট ভাইবোনেদের দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়ল। পাড়া-বেড়ানো দাপুটে সাইক্লিস্ট তখন বিবেকানন্দ রোড থেকে শিয়ালদহ কিংবা বেলেঘাটার রাসমণি বাগানে হেঁটে হেঁটে টিউশন করছেন। বছর ছয়েক বাদে বিয়ে হওয়া ইস্তক এ ভাবেই চলেছে। বিয়ের পরে গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। চিত্রার লেখা পুরস্কার-প্রাপ্ত গল্পের প্রশংসা করেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সাইক্লিস্ট চিত্রাকে আর পাওয়া যায়নি। “বাবা বকলেও মা বরাবর বলতেন, খেলা ছাড়বি না। মেয়েদের গতে-বাঁধা জীবনে কিছু একটা অন্য রকম থাকুক।” মায়ের কথা পালন করা হয়নি। তাই আজ মেরিকে দেখে এত উচ্ছ্বসিত চিত্রা। পোর্টেবল টিভিতে অলিম্পিকে মেয়েদের ইভেন্টগুলো গিলেছেন গোগ্রাসে। চিনের ১৬ বছরের বিস্ময়-সাঁতারুতে মুগ্ধ হয়েছেন চিত্রা। আবার এ দেশের মেরি কম ছাড়া সাইনা নেহওয়াল বা ‘মিষ্টি হাসি’র দীপিকা কুমারীর লড়াইও ছুঁয়ে যাচ্ছে বৃদ্ধাকে। কিন্তু ক’জনই বা পারলেন জিততে? “পদকটাই শেষ কথা নয়। এই মেয়েগুলোকে দেখে বুঝি, ভবিষ্যতের চিত্রারা আর হেরে যাবে না।” আর একটি স্বাধীনতা দিবসের ভোরে প্রবীণ নাগরিকের এই বিশ্বাসটুকুই আপাতত সম্বল। |