স্বাধীনতার এত দিন পরেও কি গড়ে উঠেছে কোনও জাতীয় নাট্যশালা? একটা নাট্যশালা
চালাতে কত
টাকা আর লাগে? প্রত্যেক সরকারের আমলেই কত দিকে কত টাকা বাজে খরচ হয়। লিখছেন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
ঋণের দায়ে শ্রীরঙ্গম ছাড়তে হল শিশিরকুমার ভাদুড়িকে। শুধু অভিনয় নয়, এখানে একটা ঘরে তিনি মাঝে মাঝে রাত কাটাতেন। আদালতের ডিক্রি নিয়ে সেই বাড়ির মালিক এক দুপুরে শিশিরকুমারকে বিতাড়িত করার ব্যবস্থা হল, তাঁকে বার করে দেওয়া হল রাস্তায়, তাঁর ব্যবহৃত অনেক জিনিস, যেমন তাঁর জামা-কাপড়, জুতো। এই দৃশ্য দেখার জন্য সেখানে ভিড় জমা তো স্বাভাবিক। শিশিরকুমার আগে বাংলা রঙ্গমঞ্চের সম্রাট বলে গণ্য হতেন।
শিশিরকুমার মঞ্চ থেকে সব সংস্রব কাটিয়ে থাকতে লাগলেন বরানগরের এক বাড়িতে। তখনও বরানগর ছিল কলকাতা থেকে দূরে, নিরিবিলি মফস্সল। অত্যন্ত অহংকারী পুরুষ তিনি, কারও কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্য নিতে রাজি নন। এক সময়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন, সে সবই ঐতিহাসিক নাটক কিংবা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ, সবই নাটক হিসেবে খুব দুর্বল। তিনি সব সময়ই চাইতেন নতুন, সাহিত্য গুণসম্পন্ন রচনা। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি নাটক খুব যত্ন নিয়ে মঞ্চস্থ করেছিলেন, দর্শক জোটেনি, শিশিরকুমারকে ক্ষতিস্বীকার করতে হয়েছে প্রত্যেক বার। একটি রবীন্দ্র-নাটক সাড়ম্বরে উদ্বোধন করার দিনে মোট দর্শকের সংখ্যা ছিল ছ’জন। তিনি চাইতেন লাভ-ক্ষতির হিসেব না করে এমন একটি জাতীয় থিয়েটার কেন্দ্র। যেখানে হবে নতুন নতুন সত্যিকারের নাটক চর্চা, নতুন নট-নটীদের ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তোলা। অনেক দেশেই সরকার এ রকম প্রতিষ্ঠান চালাবার দায়িত্ব নেয়। আমাদের দেশে পরাধীন আমলে সরকার এ নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নাও হতে পারে। তার পর দেশ স্বাধীন হল, তখনও শিশিরকুমার তাঁর এই আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার সে রকম উদ্যোগই নেয়নি।
নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ আর পাননি জীবনে। আগে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে কয়েকবার এ বিষয়ে আলোচনাও করেছেন শিশিরকুমার। বিধানচন্দ্র রায়ের আর যত গুণই থাকুক, ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে খুব উৎসাহী ছিলেন, এ দাবিটা করা যায় না বোধ হয়। এর মধ্যে ভারত সরকার ঘোষণা করল যে, পদ্মভূষণ খেতাব দেওয়া হবে শিশিরকুমারকে। সে চিঠি পেয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন, এ যেন গরু মেরে জুতো দান! |
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের একটি দৃশ্য। |
সারা ভারতে খুব সম্ভবত শিশিরকুমারই এই সরকারি খেতাব নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এই সব ঘটনা অনেকেরই জানা। ওই সময় আমি থাকতাম উত্তর কলকতায়, মঞ্চে শিশির ভাদুড়ির শেষ দু’তিনটি নাটক দেখেছি, রাস্তাতেও তাঁকে দেখেছি কয়েকবার। অহংকারী শিশিরকুমার নিজের দুর্বলতার কোনও রকম চিহ্ন রাখতেন না। কিন্তু ওর মধ্যে নিশ্চিত একটা হাহাকার ছিল। সেটা আমি সেই কৈশোরে বুঝতে পারিনি, তবে সেই স্মৃতি রয়ে গেছে প্রায় অম্লান। শিশিরকুমারের মৃত্যুর অনেক দিন পরে টের পেয়েছি সেই হাহাকারের। স্বাধীনতার এত দিন পরেও কি গড়ে উঠেছে কোনও জাতীয় নাট্যশালা? একটা নাট্যশালা চালাতে কত টাকা আর লাগে? প্রত্যেক সরকারের আমলেই কত দিকে কত টাকা বাজে খরচ হয়! তবে শুনেছি, নান্দীকারের রুদ্রপ্রসাদ, আরও কোনও কোনও দল নিজেদের উদ্যোগে পথশিশু কিংবা বস্তির ছেলে-মেয়েদের ট্রেনিং দিয়ে কিছুটা সুস্থ জীবনের স্বাদ দিতে পেরেছেন। অলকানন্দা রায় জেলখানার কয়েদিদের নিয়ে নাচ-গান-নাটকের শিক্ষার মধ্য দিয়ে যে আশ্চর্য কাজ করেছেন, তা অভূতপূর্ব তো বটেই এবং তা অবিস্মরণীয়। আমাদের নাট্যজগৎ-এর মান এখন বেশ উঁচুতে, তা নিয়ে আমরা অবশ্যই গর্ব করতে পারি।
মিনার্ভা থিয়েটার বহুদিন বন্ধ থাকার পর এখন সারিয়ে-সুরিয়ে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়েছে। যত দূর মনে হচ্ছে, এর মালিকানা এখন রাজ্য সরকারের, তা হলে এটাকেই এখন কি জাতীয় নাট্যশালা হিসেবে গণ্য করা যায়? অন্তত মিনি জাতীয় নাট্যশালা! এবং এরই মধ্যে এ থেকে একটি চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছে, যার নাম মিনার্ভা রেপার্টরি থিয়েটার। এরই মধ্যে পাদপ্রদীপের সামনে এসেছে তিনটি নাটকের উপস্থাপনা, তিনটিই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, প্রতিটি দেখেই আমি মুগ্ধ। প্রথমটি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অসাধারণ অভিনয় সমৃদ্ধ শেক্সপিয়ার অবলম্বনে রাজা লিয়ার। তার পর মনোজ মিত্রের নাটক, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় দেবী সর্পমস্তা (যেটা আমার বার বার দেখার ইচ্ছে হয়) আর তৃতীয়টি, অতি সম্প্রতি ডি এল রায়ের বহু-চর্চিত নাটক চন্দ্রগুপ্ত। এটা এমন কিছু আহা মরি নাটক নয়, কৃত্রিমতা প্রচুর, তবু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মের দেড়শো বছর পালন উপলক্ষে তাঁর প্রতি সম্মান জানানোর জন্য তাঁর একটি নাটক নির্বাচন করা ঠিকই আছে। এর সঙ্গে অবশ্য জি পি দেশপাণ্ডের একটি নাটকের কিছু দৃশ্য মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
চন্দ্রগুপ্ত নাটকের ত্রুটিগুলি অনেকটাই ঢেকে দিয়েছেন পরিচালক কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। তিনি এনেছেন গতি, যার ফলে দর্শকদের কেউই কয়েক চুমুক ঘুমিয়ে নেবার সুযোগ পাবেন না। এই কৌশিক চট্টোপাধ্যায় থাকেন কৃষ্ণনগরে। কলকাতার কোনও নাট্য দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থেকেও তিনি অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এই নাটকের নির্দেশনায়। দুর্বল নাটকের মঞ্চ-সাফল্য আনা খুবই কঠিন কাজ, কৌশিক সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে অনেকটাই জয়ী হয়েছেন।
দেবী সর্পমস্তা দেখতে গিয়ে শুনেছিলাম, প্রায় সব কুশিলবকেই আনা হয়েছে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে। তাদের কেউ কেউ আগে কখনও মঞ্চে ওঠেনি। কয়েক মাস তাদের এখানেই রেখে দিয়ে তাদের নাচ-গান-অভিনয় শেখানো হয়েছে, তাদের সার্থকতার প্রধান নিদর্শন, মঞ্চে তাদের সাবলীল বিচরণ। যারা সদ্য সদ্য গান বা নাচ শিখেছে, তাদের কোথাও তাল কাটেনি।
চন্দ্রগুপ্ত দেখতে গিয়েও শুনলাম, এই নাটকেও প্রায় কোনও খ্যাতিমান নেই, সেই আগের দলের ছেলে-মেয়েরাই এ নাটকে অংশগ্রহণ করেছে। দু’টি বিপরীতধর্মী নাটক, চরিত্র বদল করা কম কঠিন নয়। আমি চেষ্টা করছিলাম, আগের নাটকে যারা খুব ভাল অভিনয় করেছিল, তাদের এই নাটকে চেনা যায় কি না। পোশাক-পরিচ্ছদ অন্য রকম, সংলাপও সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের, তা হলে আর চিনব কী করে? এই নাটকের রাজা নন্দ অনেকটা ভিলেন ধরনের, আর তার উপস্থিতিও অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং নন্দও শুধু সাদা বা কালো নয়, অনেকটা িসরিও কমিক ধরনের, এবং সে নাচতে পারে, গাইতেও পারে, তার অভিনয় অন্যদের ছাপিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এক সময় আবিষ্কার করলাম, আরে! এ তো দেবী সর্পমস্তার প্রধান চরিত্রটি। এর নাম অনির্বাণ ভট্টাচার্য। আমি এর মধ্যেই ওর ভক্ত হয়ে উঠেছি, আমার দৃঢ় ধারণা, এই ছেলেটি আরও অনেক নাটকে ফাটাবে। চাণক্যের মতন কঠিন চরিত্রের অভিনেতা অধিকারী কৌশিকও ছিল আগের নাটকে। আর অনেককে চিনতে পারলাম না, তবে সবারই অভিনয় বেশ স্বচ্ছন্দ।
একটা ছোট কথা। কোনও নাটকের পটভূমি হয় কয়েক শতাব্দী আগের কোনও ঘটনা, তা হলে তাদের ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে এক বার না এক বার দু’জনের তলোয়ারের লড়াই থাকে। বিদেশের নাটকের এই সব অভিনেতাদের বেশ কিছু দিন ফেনসিং শিখতে হয়, যেমন আমরা দেখেছি হ্যামলেটের ভূমিকায় লরেন্স অলিভিয়ারকে। আমাদের বাংলা থিয়েটার বা সিনেমায় এ রকম লড়াইয়ের দৃশ্য থাকলে অভিনেতারা ওসব শেখা-টেখার জন্য সময় দিতে চায় না, একটুখানি ঠুকুস-ঠাকুস করেই পরের দৃশ্যে চলে যায়। এই নাটকেও রাজা নন্দ আর চন্দ্রগুপ্তের একটা তলোয়ারে লড়াইয়ের দৃশ্য আছে। আমি সবিস্ময়ে দেখলাম, এই নাটকে দুই তলোয়ারধারীর লড়াই খুবই বাস্তবসম্মত, নাচের কোরিওগ্রাফির মতন পদক্ষেপ নিখুঁত। যেন রোনাল্ড কোলম্যান আর ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস, জুনিয়ার।
মিনার্ভা রেপার্টরির সভাপতি ব্রাত্য বসু। সে সত্যিকারের এক ক্ষমতাবান নাট্যকার আর অভিনেতা হিসেবেও দুর্দান্ত, অতি সম্প্রতি মুক্তধারা চলচ্চিত্রে তার অভিনয় বহুদিন মনে রাখার মতন। এখন সে এই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। এই দফতরের মন্ত্রীর কাজ অনেক বেশি আর ঝঞ্ঝাটও হয় প্রত্যেক দিন। তবু ব্রাত্যকে আমরা অনুরোধ করব, মন্ত্রিত্বের ব্যস্ততার মধ্যেও যেন তার থিয়েটার-সংসর্গ অটুট থাকে। এই
রেপার্টরি আরও অনেক নতুন উদ্যোগ নিতে পারে, এবং রাজনৈতিক দলাদলি ও পক্ষপাতিত্ব যেন এই ধরনের কাজ ছিন্নভিন্ন করে না দেয়।
আবির দিয়ে রাঙাও তাকে ঘাতক এত রক্তধারায় খুঁজছ কাকে? আবীর দিয়ে রাঙাও দেখি সভ্যতাকে।
|
(নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুমিও জ্বরের মতো এসো’ কাব্যগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত) |