বেসরকারি শিল্পের জন্য সরকারের তরফে এক ছটাকও জমি অধিগ্রহণের পক্ষপাতী নন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু পাঁচ বছর টানাপোড়েনের পরে গত কাল বিলের যে খসড়া চূড়ান্ত করেছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক, তাতে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে রাজ্য সরকারগুলিকে। শরিক তৃণমূলের আপত্তি আঁচ করে অবশ্য একই সঙ্গে কেন্দ্র এ-ও বলছে যে, কোনও রাজ্য সরকার ইচ্ছে করলে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা না-ই নিতে পারে। তবে আইনের এই ‘ফাঁক’ দিয়ে মমতাকে কতটা তুষ্ট করা যাবে, তা নিয়ে কংগ্রেস ও প্রশাসনিক মহলের একটা অংশ সন্দিহান।
প্রস্তাবিত জমি বিল প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ বলেছেন, “কোনও রাজ্য না চাইলে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে হস্তক্ষেপ না-ও করতে পারে। সেটা ওই রাজ্যের ব্যাপার। আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা প্রয়োগ করে বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ না করার অধিকার তাদের থাকবে।”
জমি বিলের নবতম সংস্করণে তৃণমূলের সম্মতি মিলবে কি? এ ব্যাপারে জয়রাম ‘আশাবাদী’ হলেও তাঁর মন্ত্রকের এক শীর্ষ আমলার বক্তব্য, এটা ঠিক যে, প্রস্তাবিত বিল বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে রাজ্য সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য করবে না। তবে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে যখন আর পাঁচটা রাজ্য হস্তক্ষেপ করবে, তখন পশ্চিমবঙ্গে মমতার সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে পারে শিল্প মহল। তাঁর কথায়, “শিল্প মহলের চাপের কাছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নতি স্বীকার না করলে বিনিয়োগের জন্য অন্য রাজ্য বেছে নেবে শিল্প সংস্থাগুলি। এই বিষয়টি তৃণমূল নেতৃত্বও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। ফলে নতুন খসড়া নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের আপত্তির আশঙ্কা এখনই উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।” |
নয়া খসড়া জমি বিল নিয়ে একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “নতুন বিল পাশ হলে বৈষম্যের বাতাবরণ তৈরি হবে। তখন পশ্চিমবঙ্গে আর কেউ শিল্পস্থাপনে আগ্রহী হবে না।” তাঁর কথায়, “তৃণমূল এখনও মনে করে, শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না। মুক্ত বাজারে বিশ্বাস করেন শিল্পপতিরা। তাঁদের মুনাফার অংশ যখন তাঁরা সরকারকে দেন না, তখন তাঁদের জন্য সরকারই বা জমি অধিগ্রহণ করতে যাবে কেন?” রাজ্যের ভূমি রাজস্ব দফতরের প্রাক্তন এই আমলা জানান, বিলের নতুন খসড়া কেন্দ্র কলকাতায় পাঠালে তা নিয়ে বিবেচনা করেই অবস্থান ঠিক করবেন মমতা।
দেবব্রতবাবুর ‘আশঙ্কা’র পাল্টা যুক্তিও দিচ্ছেন অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, ধরা যাক, মমতার দাবি মেনে জমি অধিগ্রহণে সরকারের কোনও ভূমিকাই রইল না। কিন্তু সেই সঙ্গেই বিলে এই সংস্থানও রেখে দেওয়া হল যে, কোনও রাজ্য ইচ্ছে করলে আইন করে জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। তাতেও আখেরে সমস্যায় পড়বে পশ্চিমবঙ্গই।
সরকারের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মমতা দিল্লি এলে জমি বিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবেন। মমতাকে প্রধানমন্ত্রী বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে, প্রস্তাবিত জমি বিলে তৃণমূল সমর্থন জানালে তা পশ্চিমবঙ্গেও শিল্পায়নের সহায়ক হবে। তা ছাড়া কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের
ব্যাপারে কেন্দ্র কোনও আপস করছে না। বরং নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনও রাজ্য চাইলে বিলে প্রস্তাবিত পরিমাণের তুলনায় বেশি ক্ষতিপূরণ দিতে পারে কৃষকদের।
বস্তুত গত বছর যে জমি বিল সংসদে পেশ করেছিল মনমোহন সরকার, শিল্পের জন্যের জমি অধিগ্রহণে রাজ্যের সীমিত হস্তক্ষেপের প্রস্তাবই তাতে ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিলটি পর্যালোচনা করে গত ১৮ মে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি জানিয়ে দেয়, বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে রাষ্ট্রের কোনও অধিকারই থাকতে পারে না। স্থায়ী কমিটির ওই রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর প্রবল নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায় শিল্প মহল। আর তার পরেই জয়রাম বলেছিলেন, “বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে রাষ্ট্রের অধিকার থাকতেই হবে। দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের জন্যই তা অপরিহার্য।” শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থানেই অটল থাকতে চাইছে কেন্দ্র। স্থায়ী কমিটির যাবতীয় সুপারিশ, শিল্প মহলের মতামত ও আন্তঃমন্ত্রক আলোচনার পর কেন্দ্র যে চূড়ান্ত খসড়া বিল তৈরি করেছে তাতে বলা হয়েছে, ‘৮০ শতাংশ জমির মালিক সম্মতি দিলে সরকার জনস্বার্থে বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে’।
প্রস্তাবিত খসড়ায় জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণের সংজ্ঞা আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, “সাধারণ মানুষের পরিষেবায় কোনও পরিকাঠামো প্রকল্প, সামাজিক পরিকাঠামো বা জনসম্পদ উন্নয়নের স্বার্থে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে (পিপিপি) প্রকল্প পত্তনের জন্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে।” প্রসঙ্গত, পিপিপি প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণেও সরকারের ক্ষমতা বিলোপের পরামর্শ দিয়েছিল স্থায়ী কমিটি। এরই পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণের ব্যাপারে রাজ্যের হাতে অধিকতর ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে চূড়ান্ত খসড়ায়।
মন্ত্রিসভার এক বর্ষীয়ান সদস্যের কথায়, “তৃণমূলকে কেন্দ্রের বাধ্যবাধকতাও বুঝতে হবে। শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে তৃণমূলের আপত্তি থাকতেই পারে। কিন্তু যে রাজ্যগুলির সেই আপত্তি নেই, তাদের পথে বাধা সৃষ্টি করার অধিকারও তৃণমূলের নেই।” তাঁর যুক্তি, জমি জটে আটকে একের পর এক রাজ্যে নতুন শিল্প স্থাপন ও সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে পরিকাঠামো প্রকল্প আটকে রয়েছে। নতুন জমি বিল পাশ হলে সেই বাধা কাটবে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগের বাতাবরণও চাঙ্গা হবে। জয়রাম জানিয়েছেন, গত কাল যে খসড়া বিলটি চূড়ান্ত করা হয়েছে, সেটিই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
তবে এর পরেও মূল প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। কেন্দ্রের এই খসড়ায় কি সম্মতি দেবে তৃণমূল? |