মানুষের ‘পাশে দাঁড়াতে’ ভরসা নাচ-গানের টাকা
সাপের ছোবলে উদয় সিংহের তখন যায় যায় অবস্থা। ওঝা-গুণিন ডেকে ঝাড়ফুঁক চলছিল। খবর যায় উজ্জ্বল মান্ডি, উৎপল মান্ডিদের কাছে। তাঁরা পরামর্শ দেন, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে রোগীকে। কিন্তু বর্ধমানের প্রত্যন্ত মাধবডিহির শ্রীরামপুর গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারটির সেই আর্থিক সামর্থ্য কোথায়! উজ্জ্বলরা নিজেরাই তখন অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে উদয়কে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সে যাত্রা প্রাণে বেঁচেছেন বছর তিরিশের উদয়। পেশায় দিনমজুর উদয়ের কথায়, “ওঁরা না থাকলে সে বার আর বাঁচতে হত না। এখন আমিও গ্রামের লোককে বোঝাই, সাপে ছোবল দিলে ওঝা ডেকে কিস্সু হবে না। বাঁচাতে চাইলে হাসপাতালে নিয়ে যাও।”
উদয়ই শুধু নন, উজ্জ্বল-উৎপলরা নানা সময়ে বিভিন্ন ভাবে গ্রামের মানুষের ‘পাশে দাঁড়ান’। কখনও খরচ করে বিয়ে দেন দরিদ্র পরিবারের মেয়ের। কখনও কাউকে চিকিৎসার টাকা জোগান। পড়ার খরচ দেন অভাবী মেধাবীকে। কিন্তু এ সব সাহায্যের আর্থিক উৎসটা কী?
উজ্জ্বলরা কেউ পেশায় দিনমজুর, কেউ ক্ষৌরকার, কেউ চাষি বা কাঠমিস্ত্রি। আর্থিক দিক থেকে ‘স্বচ্ছল’ বলা যায় না কাউকেই। কিন্তু মাধবডিহির কাইতি গ্রামের এই সব মানুষ এক সঙ্গে গড়ে তুলেছেন ‘কাইতি আনন্দতীর্থ আদিবাসী ও লোকসংস্কৃতি সঙ্ঘ।’ লুপ্তপ্রায় আদিবাসী সংস্কৃতির চর্চা করেন সকলে। সমাজসেবার জন্য প্রয়োজনীয় টাকার জোগান আসে সেখান থেকেই। সঙ্ঘের সদস্যরা জানান, যে যার পেশায় যা রোজগার হয়, তাতে সংসার চলে যায়। অনুষ্ঠান করে পাওয়া টাকা মানুষের উপকারেই খরচ করেন।
মাধবডিহির কাইতি গ্রামে অনুশীলনে সঙ্ঘের সদস্যেরা। মোহন দাসের তোলা ছবি।
১৯৯৫ সালে পথচলা শুরু এই সঙ্ঘের। এলাকার পাঁচ যুবক উজ্জ্বল, উৎপল, সুভাষ হেমব্রম, বিশ্বরূপ বেজ এবং পলাশ দাস তখন কলেজে পড়েন। পাশাপাশি দিনমজুরি করে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। বিকেলের দিকটা আড্ডা দিয়েই কেটে যেত। এক সময়ে মনে হল, তাঁরা তো আদিবাসী নাচ-গানও কিছু কিছু জানেন। সে সব চর্চা করলে সময়টা ভাল কাটবে। সেই শুরু।
কিন্তু সংস্কৃতি চর্চার প্রথাগত শিক্ষাও তো দরকার। কলকাতায় ‘ব্রতচারী কেন্দ্রীয় নায়ক-মণ্ডলী’র সঙ্গে তাই যোগাযোগ করেন উৎপল, সুভাষরা। প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। যোগাযোগ হয়ে যায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হীরালাল চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি ছৌ নাচ শেখান পাঁচ জনকে। এক বছর তালিমের পরে তৈরি হয় ওই সঙ্ঘ। ছৌ ছাড়াও ঢালি নৃত্য, শিকারি নৃত্য, কাঠি নৃত্য, রায়বেশে, রণপা নৃত্য পরিবেশন করেন তাঁরা। টুসু, ভাদুও গান তাঁরা।
প্রথম কয়েক বছর এলাকায় পুজো-পার্বণে সামান্য সময়ের জন্য ডাক পেতেন। পরে হুগলি, হাওড়া, দুই মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম-সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আমন্ত্রণ আসতে শুরু করে। কলকাতা, দিল্লি, অসম, মেঘালয়, সিকিমেও গিয়েছেন।
কাইতির পূজা রায়ের বিয়ের খরচের একটা অংশ জুগিয়েছে সঙ্ঘ। পূজার বাবা টুনিবাবু বলেন, “ওঁরা অনেককে সাহায্য করেন বলে শুনেছিলাম। আমার অসুবিধার কথা বলাতে প্যান্ডেল খরচের পুরো টাকাটাই দিলেন।” ডোনা ভট্টাচার্যের ক্যানসার চিকিৎসার খরচের একটা বড় অংশও দিয়েছে সঙ্ঘ। কলেজ ছাত্রী শীলা মান্ডির পড়ার খরচ চলে সঙ্ঘের টাকায়। উজ্জ্বল বলেন, “লোকশিল্পকে বাঁচানোর একটা দায় রয়েছে আমাদের। সেই সঙ্গে নাচ-গানের টাকা জমিয়ে নানা ধরনের কাজ করি। এতেই আমাদের আনন্দ। তবে সংস্কৃতি চর্চার জন্য সরকারি কিছু অনুদান পেলে ভাল হত।”
বর্ধমান জেলার তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক বরুণ সাহা জানালেন, সরকারি অনুদানের জন্য নির্দিষ্ট দফতরে আবেদন করতে হয়। সে কথা ইতিমধ্যে তিনি সঙ্ঘের সদস্যদের জানিয়েছেন। রায়না ২ বিডিও রবীন্দ্রনাথ বাড়ুই বলেন, “হুল উৎসবে ওঁদের অনুষ্ঠানের জন্য ডাকা হয়েছিল। সরকারি সাহায্যের আবেদন করলে আমরা নিশ্চয়ই তাতে উৎসাহ দেব।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.