পার্ক স্ট্রিট, এক্সাইড মোড়ের পরে এ বার চেতলা। ফের খাস কলকাতার বুকে এক মহিলাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠল। অভিযোগ, শনিবার ভরসন্ধ্যায় এক দল দুষ্কৃতী চেতলা সেতুর কাছ থেকে ওই মহিলাকে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে রাতভর ধর্ষণ করে। তার পরে যেখান থেকে তাঁকে তোলা হয়েছিল, রবিবার কাকভোরে সেখানেই তাঁকে ওরা ফেলে আসে বলে পুলিশকে জানিয়েছেন বছর ছাব্বিশের ওই মহিলা।
মহিলা রবিবারই চারু মার্কেট থানায় ধর্ষণের নালিশ দায়ের করেন। পুলিশ-সূত্রের খবর: লিখিত অভিযোগে দশ জন ‘অপরিচিত’ দুষ্কৃতীর সঙ্গে ‘ছেনো’ নামে এক যুবকের নামও তিনি লিখেছেন। সোমবার কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “ঘটনায় জড়িত অভিযোগে অজয় ভট্টাচার্য ওরফে ছেনোকে গ্রেফতার করা হয়েছে। থানায় লিখিত অভিযোগে মহিলা জানিয়েছেন, ছেনো তাঁকে কয়েক দিন ধরে হুমকি দিচ্ছিল।”
গত ৫ ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিটের এক পাঁচতারা হোটেলের সামনে এক মহিলাকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিল পাঁচ যুবক। অভিযোগ, তাঁকে ধর্ষণ করে এক্সাইড মোড়ের কাছে ফেলে দিয়ে যায় তারা। ওই ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্তের নাগাল পুলিশ এখনও পায়নি। আবার গত ৮ জুন রাতে এক্সাইড মোড় থেকেই ব্যারাকপুরের এক গৃহবধূকে গাড়িতে তুলে নিউটাউনের নির্জনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে এক যুবকের বিরুদ্ধে। পরে এন্টালিতে সে ধরা পড়ে। |
শনিবার সন্ধ্যায় চেতলায় কী ঘটেছিল?
পুলিশ-সূত্রের খবর: টালিগঞ্জের বাসিন্দা বিবাহবিচ্ছিন্না ওই মহিলা আয়ার কাজ করে সংসার চালান। শনিবার সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ চেতলা সেতু পেরিয়ে তিনি পশ্চিমে আলিপুরের দিকে কাজে যাচ্ছিলেন। পুলিশকে তিনি জানিয়েছেন, গৌড়ীয় মঠের কাছাকাছি আচমকা একটি গাড়ি তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়িতে বসা একটি ছেলে তাঁকে প্রশ্ন করে, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’ তিনি বলেন, ‘কাজে যাচ্ছি।’ তখন হুমকির সুরে এক জন তাঁকে বলে, ‘খুব সাহস বেড়েছে তোর! গাড়িতে ওঠ।’
অভিযোগে মহিলা জানিয়েছেন, তিনি গাড়িতে উঠতে না-চাওয়ায় একটি ছেলে জোরাজুরি করতে থাকে। আর তারই ফাঁকে দু’টি যুবক গাড়ি থেকে নেমে রুমাল দিয়ে তাঁর চোখ বেঁধে ফেলে। মহিলার দাবি, তিনি চিৎকার করতে গেলে ‘কেটে টুকরো-টুকরো করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দেয় তারা। ফলে ভয়ে তিনি আর চেঁচাননি। এর পরে তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলা হয়।
গাড়ি ওঁকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল?
মহিলার বক্তব্য: চোখ বাঁধা থাকায় তিনি তা বুঝতে পারেননি। তবে প্রায় আধ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে তাঁকে একটা ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে তোলা হয়েছিল। আর সেখানেই দু’টি ছেলে তাঁকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করে বলে তাঁর অভিযোগ। পুলিশকে তিনি এ-ও জানিয়েছেন, ধর্ষণকারীরা কন্ডোম ব্যবহার করেছিল। পরে তাঁকে মারধরও করা হয়। শেষে রবিবার ভোর চারটে নাগাদ তাঁকে ফের চেতলা সেতুর কাছে ফেলে দিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। এ দিন আদালতেও ওই মর্মে জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি।
পুলিশ-সূত্রের খবর: মহিলা বাড়ি ফিরে মা-বাবাকে কিছু বলেননি। তবে রবিবার সকালে যোগাযোগ করেছিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা স্বরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে। স্বরূপ ও তাঁর স্ত্রী জুঁই ওঁকে নিয়ে রবিবার দুপুরে চারু মার্কেট থানায় যান। মহিলা পুরো গোটা ঘটনাটি থানায় অভিযোগের আকারে নথিভুক্ত করেন। এ ব্যাপারে এ দিন স্বরূপবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য বলেন, “কোনও মন্তব্য করতে চাই না। দয়া করে পুলিশের সঙ্গে কথা বলুন।”
পুলিশ যাকে ধরেছে, সেই ছেনো কে?
পুলিশের দাবি: স্থানীয়-সূত্রে জানা গিয়েছে, ধৃত ছেনো ওরফে অজয় পুরনো তৃণমূলকর্মী। এবং একদা অরূপবাবুর সঙ্গে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠতা’ থাকলেও বর্তমানে সে বিধানসভায় দলের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ।’ যদিও এই ঘটনা প্রসঙ্গে শোভনদেববাবুর বক্তব্য, “কাউকে আড়াল করতে চাই না। দোষীদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। আমি দু’জনেরই মেডিক্যাল পরীক্ষার কথা বলছি।” অভিযোগকারিণীর মেডিক্যাল পরীক্ষা এ দিন এসএসকেএমে হয়ে গিয়েছে। তার রিপোর্ট এখনও মেলেনি বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এ দিন দুপুরে ‘ঘটনাস্থলে’ গিয়ে দেখা যায়, চেতলা ব্রিজে ওঠা ও নামার মুখে দু’টো ট্র্যাফিক গার্ড ছাড়া পুলিশি নজরদারির তেমন ব্যবস্থা নেই। তবে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ কিংবা চেতলা সেন্ট্রাল রোড ব্রিজের যে দিকই হোক, এক মহিলাকে কয়েকটি ছেলে মিলে জবরদস্তি গাড়িতে তোলার দৃশ্য কারও নজরে পড়ল না কেন, তা নিয়ে খটকা রয়েছে তদন্তকারীদের। বিশেষত জায়গাটা যেখানে এমনিতেই জনবহুল, এবং সময়টি ছিল সন্ধে মাত্র সাড়ে সাতটা!
গাড়িতে তোলার পরে ওই মহিলাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে পুলিশও ধোঁয়াশায়। উপরন্তু মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হওয়ায় ওই ‘দশটি ছেলের’ বিষয়েও স্পষ্ট কিছু মনে করতে পারছেন না। ঘটনার পিছনে ব্যক্তিগত কোনও আক্রোশ কাজ করছে কি না, তা-ও যাচাই করে দেখছে পুলিশ।
মহানগরে ফের এমন কাণ্ড যদি সত্যিই ঘটে থাকে, সেটা কি আইন-শৃঙ্খলার অবনতির সূচক?
রাজ্য সরকারের কর্তারা অবশ্য তা মানতে নারাজ। বরং পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের (ঘটনাচক্রে যিনি চেতলারই বাসিন্দা) দাবি, “কলকাতার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভাল। পুলিশ এখন দ্রুত ও যথা সময়ে ব্যবস্থা নেয়।” চেতলার ঘটনা প্রসঙ্গে পুরমন্ত্রী এ দিন মহাকরণে বলেন, “পুলিশকে বলেছি দ্রুত অপরাধীদের ধরে শাস্তির ব্যবস্থা করতে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বলেই তো শাস্তি দেওয়ার বিধান! দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে অপরাধীরা ধর্ষণ করতে ভয় পাবে।” অন্য দিকে চেতলা-কাণ্ডের জেরে সরকারকে আক্রমণ করেছে বিরোধীরা। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর অভিযোগ, “রাজ্যে মহিলাদের উপরে নির্যাতন বাড়ছে। সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমন হলে নির্যাতন বাড়বেই।”
|
খটকা যেখানে |
• ভরসন্ধ্যায় জোর করে গাড়িতে তোলা হলে কেউ দেখতে পেল না কেন? |
• মহিলা ঘটনার কথা তাঁর বাবা-মাকে কেন জানালেন না? |
• পুলিশের কাছে না গিয়ে নেতাদের কাছে কেন গেলেন? |
|