পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণ মামলার অন্যতম অভিযুক্ত কিম ডেভির প্রত্যর্পণের বিষয়ে ভারতের ‘সদিচ্ছা’ নিয়েই এ বার প্রশ্ন তুলল ডেনমার্ক। তার জেরে চরমে উঠল দু’দেশের কূটনৈতিক যুদ্ধ।
ডেনমার্কের বক্তব্য, ডেভির প্রত্যর্পণের বিষয়টি ভারত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। ডেভির বিরুদ্ধে তথ্য ও নথি পাঠাতে ভারতই ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ভাবে দেরি করেছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছে তারা। ভারতীয় কারাগারগুলি ‘অমানবিক’ বলেও অভিযোগ তুলেছে সে দেশ। সব মিলিয়ে ভারতের কোর্টেই যাবতীয় বল ঠেলেছে ডেনমার্ক। অন্য দিকে, দিল্লির যুক্তি, ডেভির প্রত্যর্পণের জন্য সমস্ত রকম প্রয়োজনীয় তথ্য ও নথি সংগ্রহের কাজ চলছে। গোটা বিষয়টি নিয়ে আগাগোড়া ডেনমার্ক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগও রাখা হয়েছে। কারাগার সংক্রান্ত যাবতীয় সমালোচনাও উড়িয়ে দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য, বিভিন্ন দেশের বন্দিরা ভারতের কারাগারে থাকেন। সমস্ত রকম আইনি সহযোগিতাও তাঁদের দেওয়া হয়। কাজেই এই সংক্রান্ত অভিযোগ অমূলক।
সম্প্রতি ড্যানিশ কর্তৃপক্ষ দেশের সুপ্রিম কোর্টে ডেভির প্রত্যর্পণ মামলাটি তুলতে অস্বীকার করায় দিল্লি প্রকাশ্যেই ঘোষণা করে যে, কোপেনহাগেনের সঙ্গে কূটনৈতিক চুক্তি এবং লেনদেন কমিয়ে দেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে বলা হয় এক জন সন্ত্রাসবাদীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘটনা যে কোনও সভ্য দেশের পক্ষেই অবমাননাকর। বিদেশমন্ত্রী এ ব্যাপারে চিঠি লিখে ডেনমার্কের বিদেশ মন্ত্রকের হস্তক্ষেপ চাইলেও কোনও কাজ হয়নি। এ দিকে ডেনমার্কের বক্তব্য, উচ্চ আদালতে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত ভুল করেছে দিল্লিই। এবং এই ত্রুটি দিল্লির অজ্ঞতাবশত না ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’, সেই প্রশ্নও তোলা হয়েছে।
গত বছর ৩০ জুন ডেনমার্কের হাইকোর্টের ‘ইস্টার ডিভিশন’ ডেভির প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত জেলা আদালতের রায় (যে রায় প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে) বহাল রাখে। ডেনমার্কের আইন অনুযায়ী, এর পর উচ্চ আদালতে আবেদন করার মেয়াদ ১৪ দিন, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ২০১১-এর ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে। কিছু ‘বিশেষ ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে’ আবেদন করার সময়সীমা ১ বছর বাড়ানো (এ ক্ষেত্রে ৩০ জুন, ২০১২) যেতে পারে।
কিন্তু এ বছরের ২৫ জুন, অর্থাৎ উচ্চ আদালতে আবেদনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পাঁচ দিন আগে ড্যানিশ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয় যে, ভারতীয় বন্দি আইন (১৮৯৪)-এর বিভিন্ন দিক দিল্লি এক বার খতিয়ে দেখতে চাইছে। বন্দিদের রাখার ব্যবস্থা, জেলারের কর্তব্য, ইত্যাদির মতো বিভিন্ন বিষয় এই আইনের অন্তর্গত। ডেভির প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে যে হেতু ভারতীয় কারাগারের অবস্থা নিয়ে ডেনমার্ক অসন্তুষ্ট, তাই এই আইনটি ঝালিয়ে নিতে চেয়েছিল ভারত। এর পাশাপাশি, কোনও হোটেল বা গেস্ট হাউসে রেখেই যে ডেভিকে জেরা করা হবে, সে ব্যাপারে ড্যানিশ কতৃপক্ষকে ‘কূটনৈতিক নিশ্চয়তা’ও দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
এই বিষয়টিকেই অস্ত্র করেছে কোপেনহাগেন। তারা প্রশ্ন তুলেছে ১) বন্দি আইনের বিভিন্ন দিক ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অজানা নয়। অতীতেও বহু বার এই আইনের ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার (তা-ও স্বাভাবিক সময়সীমায় নয়, ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে) মাত্র ক’দিন আগে কেন টনক নড়ল ভারতের? ২) সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার রাস্তা রয়েছে জেনেও ৫১ সপ্তাহ ডেনমার্ককে কোনও তথ্য না দিয়ে চুপ করে বসে রইল কেন ভারত? এই বিলম্ব কি নিছকই না-জেনে, নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?
পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণের তদন্তে এক সময়ে যুক্ত ছিলেন যিনি, সেই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব জি কে পিল্লাই বলছেন, “ওই ৫১ সপ্তাহ চুপ করে বসে থাকার অভিযোগ অমূলক। ডেনমার্ক সরকারের সঙ্গে নিরন্তর কথা চলেছে। ঘরোয়া ভাবে তথ্য বিনিময় হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের কারাগার ততটা খারাপ নয়, যতটা বলা হচ্ছে। আসল কথা এক দেশে যে সন্ত্রাসবাদী, অন্য দেশে সে নাগরিক!”
সরকারি সূত্রের খবর, ডেনমার্ক অভিযোগ করেছে, ভারতের কারাগারগুলিতে এখনও ব্যাপক হারে অত্যাচারের ঘটনা ঘটে চলেছে। অনেক সময় সুপরিকল্পিত ভাবেই অমানবিক ব্যবহার করা হয় বন্দিদের সঙ্গে। খুনের মতো ঘটনাও ঘটে। থাকার জায়গা, খাবার, চিকিৎসাব্যবস্থার অপ্রতুলতার খবরও নাকি তাদের কাছে রয়েছে। হোটেল বা গেস্ট হাউসে রেখে ডেভিকে জেরা করা হবে বলে ভারতের পক্ষ থেকে যে ‘কূটনৈতিক নিশ্চয়তা’ দেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয় বলেই মনে করছে ডেনমার্কের হাইকোর্ট। এ ব্যাপারে ‘কূটনৈতিক’ নয়, ‘আইনি নিশ্চয়তা’ চাওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভারতের কোনও ‘সদিচ্ছা’ এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি বলেই ডেনমার্কের আদালতের বক্তব্য। |