খাওয়াদাওয়া সেরে মায়ের সঙ্গে বেরোল রিন্টি। পাড়ায় ১৫ অগস্ট একটা খুব বড় ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’ হয়। কলকাতার অনেক স্কুল থেকে ছেলেমেয়েরা আসে। ছবি দেখে বিচার করার জন্য দু’তিন জন নামী শিল্পীকে আনা হয়। বিকেলবেলায় পাড়ার ছেলেমেয়েরা নাচগান করে। তার পর পুরস্কার বিতরণ। সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট ব্যাপার। তিন বছর বয়সে যখন সে সবে মন্টেসরিতে, তখন থেকেই এই ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’য় ছবি আঁকছে রিন্টি। এখন তো সে রীতিমতো ক্লাস ওয়ান। তবে এক বারও কোনও প্রাইজ পায়নি। রিন্টির থেকেও বেশি দুঃখ রিন্টির মায়ের। তাই তিনি ঠিক করে ফেলেছেন, যেমন করে হোক এ বছর একটা প্রাইজ রিন্টিকে পেতেই হবে।
তার জন্য অবশ্য প্রস্তুতি শুরু হয়েছে অনেক দিন আগে। পাড়ারই একটা ক্লাবের উদ্যোগে এই ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’টা হয়। সেই ক্লাবের সেক্রেটারি আবার বাবার বন্ধু। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে মায়ের মনে হয়েছে, এ বছর রিন্টিদের বিভাগে ছবি আঁকার বিষয় থাকবে ‘স্বাধীনতা’। মা ভেবেচিন্তে বাবার সঙ্গে বেশ অনেকক্ষণ আলোচনার পর ঠিক করেছেন, রিন্টি আঁকবে একটা জাতীয় পতাকা। প্রায় এক মাস ধরে রোজ সেটাকে প্র্যাক্টিস করতে হয়েছে। যা ভুলচুক হয়েছে আঁকার মাস্টারমশাই ঠিক করে দিয়েছেন। প্রথম দিকে তো রিন্টি ঠিক করে আঁকতেই পারছিল না। উড়ন্ত পতাকাটা এলোমেলো বেঁকে যাচ্ছে। স্ট্যান্ডটা কখনও বেশি লম্বা, কখনও আবার খুব বেঁটে। দড়িটাকে তো একটা ব্যাঁকাচোরা সাপ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিল না। মা তো প্রথমটায় রিন্টির কাণ্ডকারখানা দেখে রেগে আগুন। তার পর অবশ্য রোজ প্র্যাক্টিস করে করে আঁকাটা এখন অনেক ভাল হয়েছে। বিশেষ করে গত সপ্তাহে তো আঁকার মাস্টারমশাই রিন্টির পতাকার ছবি দেখে বলেই ফেললেন, বাঃ এই তো দিব্যি হয়েছে। এ রকম আঁকলে আর প্রাইজ পাওয়া কে আটকায়। শুনে তো মা আহ্লাদে আটখানা। রিন্টিও ভারী খুশি।
১৫ অগস্ট সকালে তাই পেনসিল, ইরেজার, মোম রঙের বাক্স, ক্লিপ বোর্ড সব নিয়ে, সুন্দর একখানা গোলাপি রঙের ফ্রক পরে, রিন্টি মায়ের হাত ধরে ক্লাবে গিয়ে হাজির। মস্ত হল ঘর। সার দিয়ে বসেছে ছেলেমেয়েরা। ক্লাবের ছেলেরা বাচ্চাদের সবাইকে একটা করে সাদা কাগজ দিয়ে গিয়েছে। তাতেই ছবি আঁকতে হবে। কাগজটা হাতে পেয়ে এ দিক ও দিক একটুখানি দেখে নিয়ে রিন্টিও শুরু করল ছবি আঁকতে।
এক ঘণ্টা পরে আঁকা শেষ করে মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরছে রিন্টি। বেশ খুশি খুশি মুখে মা জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন ছবি আঁকলি রে রিন্টি? এক দম ঠিকঠাক এঁকেছিস তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব সুন্দর এঁকেছি। মাথা নেড়ে বলে রিন্টি।
পতাকার দড়িটা ঠিক করে এঁকেছিস? ফুলগুলো? মাস্টারমশাই যেমন দেখিয়ে দিয়েছিলেন...
মায়ের কথার মাঝখানেই বাধা দিয়ে রিন্টি বলে ওঠে, পতাকা তো আমি আঁকিনি।
পতাকা আঁকিসনি? তা হলে কী আঁকলি তুই?
রাস্তার মাঝখানেই মা দাঁড়িয়ে পড়েছেন। মায়ের মূর্তি দেখে রিন্টিও একটু ঘাবড়ে গিয়েছে, তাই করুণ ভাবে বলে, না আমি আসলে...
কিন্তু মায়ের তখন আর কোনও কিছুই শোনার মতো ধৈর্য নেই। এত দিন ধরে, এত কষ্ট করে তোমাকে শেখানো হল, আর তুমি কি না সেটা আঁকলে না। তোমার মতো অবাধ্য মেয়ে আমি কখনও দেখিনি। আমার একটা কথা যদি তুমি শোনা। এই জন্য তোমার কিছু হয় না। আমি যতই চেষ্টা করি না কেন, নিজেরও একটা ইচ্ছে থাকা দরকার..। বকুনি চলতেই থাকে।
ততক্ষণে রিন্টির দু’চোখ দিয়ে জল পড়ছে। বাড়ি ফিরেও মায়ের বকুনি কিংবা রিন্টির কান্না কোনওটাই বন্ধ হয় না। সব শুনে বাবাও ভারী গম্ভীর হয়ে বলেন, সত্যি রিন্টি এটা তো ঠিক নয়। মা তোমাকে এত দিন ধরে এত কষ্ট করে শেখাল আর তুমি কি না সেটা না এঁকে অন্য ছবি এঁকে এলে। মায়ের কথামতো আঁকলে তুমি এ বার প্রাইজ পেতে। এ রকম ইচ্ছে খুশিমতো করলে তো তুমি কোনও দিনই প্রাইজ পাবে না।
খাওয়ার পর মা যখন একটু বিশ্রাম নিতে ঘরে গিয়েছেন আর রিন্টি সোফায় বসে ছবির বই দেখছে, তখন দাদু এসে পাশে বসে জানতে চাইলেন, আচ্ছা দিদিভাই, মা তোমাকে এত দিন ধরে, এত চেষ্টা করে প্র্যাক্টিস করাল, তুমি ছবিটা আঁকলে না কেন?
আমার ইচ্ছে করেনি দাদু।
কেন, ইচ্ছে করল না কেন?
সবাই যে পতাকার ছবিই আঁকছিল।
সবাই পতাকার ছবি আঁকছিল? দাদু তো অবাক।
হ্যাঁ গো। আমার পাশে শম্পি একটা বেদির ওপর পতাকা আঁকল। তিয়াসা একটা ট্যারাব্যাঁকা কী যেন আঁকল, ওটা নাকি আমাদের দেশের ছবি। তার ওপর একটা পতাকা। বাপ্পা একটা বাড়ি এঁকেছে, মাথায় পতাকা। সবাই পতাকা এঁকেছে দেখে আমার আর পতাকা আঁকতে ইচ্ছে করল না।
তা হলে তুমি কী আঁকলে দিদিভাই?
সে এঁকেছি একটা জিনিস। পরে বলব তোমায়। আচ্ছা এঁকেই দেখাব না হয়।
এই বলে রিন্টি আবার ছবির বইয়ে মন দেয়। দাদুও আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে যান।
বিকেলে অনুষ্ঠান। মা তো স্পষ্টই বলে দিলেন, রিন্টি তো আর প্রাইজ পাবে না। তাই আমার যাওয়ার কোনও ইচ্ছেই নেই। বাবাও যেতে রাজি হলেন না। অগত্যা দাদুই রিন্টিকে নিয়ে রওনা দিলেন।
সব কিছু শেষ হতে হতে সন্ধে হয়ে গেল। এর পর পুরস্কার বিতরণ। এক এক করে নাম ডাকা হচ্ছে। যাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা পুরস্কার পাচ্ছে তারা ভারী খুশি। দাদুর একটু মন খারাপই লাগছে। মনে হচ্ছে, আহা রিন্টিটাও যদি একটা পুরস্কার পেত। বউমার তো মন খারাপ হবেই। অত কষ্ট করে এত দিন ধরে মেয়েটাকে শিখিয়েছিল বেচারি!
সব পুরস্কার দেওয়া হয়ে গেল। যাঁরা বিচারক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে আছেন এক প্রবীণ শিল্পী। খুব নামডাক। তিনি উঠে এলেন স্টেজের সামনে। মাইক হাতে নিয়ে বললেন, এ বছর আমাদের ছবি আঁকার বিষয় ছিল ‘স্বাধীনতা’। ছেলেমেয়েরা অনেকেই রীতিমত নিখুঁত ছবি এঁকেছে। আমরা চেষ্টা করেছি সেরাগুলিকে বেছে নিয়ে পুরস্কার দিতে। যারা পুরস্কার পাওনি তারা হতাশ হোয়ো না। তোমরা সব্বাই খুব ভাল এঁকেছ। তবে একটা পুরস্কার এখনও বাকি। আমাদের তিন বিচারকের যে ছবিটি সব থেকে বেশি ভাল লেগেছে, তাকে দেওয়া হবে একটি বিশেষ পুরস্কার। কিন্তু তার নাম ঘোষণার আগে তোমাদের ছবিটা এক বার দেখাতে চাই...।
হাতের কাগজটা আলোর সামনে উঁচু করে তুলে ধরলেন শিল্পী। তক্ষুনি পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠল রিন্টি, ওটা তো আমি এঁকেছি। তার পর চেয়ার উল্টে ছুটল ডায়াসের দিকে। দাদু অবাক হয়ে দেখলেন, শিল্পীর হাতের কাগজটাতে আঁকা আছে একটা মস্ত গাছ। তার লম্বা ডালে ঝুলছে একটা পাখির খাঁচা, যার দরজাটা খোলা। আর সেই খাঁচা থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে একটা সবুজ রঙের পাখি।

ছবি: সুমন চৌধুরী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.