|
|
|
|
|
বর্ষার সাজসতেরো |
মনসুন-এর মন বুঝে পোশাক বাছুন। যে পোশাক ভিজে ভারী হবে না, জলফোঁটারা
শরীরে
অল্প অল্প ঠান্ডা ছোঁয়া লাগাবে, তার পর গড়িয়ে পড়বে মাটিতে। চিরশ্রী মজুমদার |
থম মারা জলভরা আকাশ। দেখলেই মনে হয়, ভাবগতিক সুবিধার নয়। বেরিয়েছ কি, মাথায় জল উপুড় করে দেব। কাদা ছিটিয়ে দেব সর্বাঙ্গে। তোমার যত ভাললাগার পোশাক সব নোংরা, যাচ্ছেতাই বানিয়ে ছাড়ব। স্যাঁতসেঁতে হাওয়া এমন করে শাসালে, আমরাও একটু কুঁকড়ে যাই। এই রে, তবে বুঝি শখ-আহ্লাদ এই ক’দিন আলমারিতে তুলে রাখতে হবে। বড়দের কথাই শিরোধার্য। সব থেকে ম্লান, পুরনো জামা পরেই আষাঢ় শ্রাবণে বাইরে যেও। আমাদের অন্তরেও তখন মেঘ ঘনায় । তবে বর্ষা নিয়ে এত গান, কবিতা, পর্দার রোম্যান্টিক নাচা-গানার মানে কী? ঘরের বাইরেই যদি না বেরোতে পারলাম? বৃষ্টিকে কি শুধু কল্পনা আর বড় পর্দাতেই ভালবাসা যায়?
বাস্তবেও বৃষ্টির বন্ধু হতে চান? তাকে কাছে পেতে চান, ছুঁতে চান? তা, বৃষ্টির সঙ্গে দেখা করতে গেলে, আমাদেরও যে ওর মনের মতো হয়ে যেতে হবে। পরতে হবে আধুনিক বর্ষাবসন।
|
|
সে সব এসে গেছে নামী-অনামী বিপণিতে। এমন সব কাপড়ে তৈরি, যারা ভিজে ভারী হয়ে যাবে না। জলফোঁটারা তন্তু বেয়ে অল্প করে ঠান্ডা ছোঁয়া লাগাবে শরীরে, তার পরই গড়িয়ে পড়বে মাটিতে। কিংবা অল্প হাওয়া পেলেই শুকিয়ে গেল শিগগিরি। অর্থাৎ, বৃষ্টিকণার শিহরনটা পেয়ে গেলেন, অথচ ঠান্ডা লাগার ভয় আর নেই। এই ফেব্রিক-এর নাম রেন সিন্থেটিকস। আর আছে কিছু মিক্সড ফেব্রিকও। লিনেন, জার্সি, ভিসকোস কাপড়ের কিছু বিশেষ প্রকার। এদের অনেক গুণ। জল বসে না, কাদা লাগলেই শুকিয়ে যায়, তাকে তখন একটু ঝেড়ে দিলেই যে কে সেই। আর বর্ষা এলেই পোশাক-আশাক কেমন কুঁকড়ে যায় দেখছেন তো, সেই সমস্যাও নেই। এ নাকি বিশেষ ইস্ত্রি-টিস্ত্রির তোয়াক্কাই করে না। যেমনই রাখো, মেলে ধরলেই ফের নতুনের মতো টানটান দাঁড়িয়ে যাবে।
এই সব কাপড়ে তৈরি যে সব পোশাককে মনসুন কালেকশন বলে ডাকা হয়, তার বেশির ভাগই নি লেংথ-এই শেষ। জল-কাদায় ডরায় না। আবহাওয়ায় একটা দুঃখবিলাস, রহস্য আঁধার ভাব আছে বলে কি না জানি না, পোশাকগুলো ঝলমলে রঙের। হলুদ, সবুজ, কচি কলাপাতা এই সব। সবই লেবুর রং। খয়েরি বা আর্মি গ্রিন কেপরি, কোয়ার্টোজ। আর পোশাকগুলির হাবে-ভাবে কোথায় যেন নিরক্ষীয়
বৃষ্টি-অরণ্যের প্রভাব। অমনি জংলা প্রিন্ট, বড় বড় পাতা, বিশাল বিশাল পাপড়িওয়ালা ফুলের ছাপ দেওয়া। কোনওটা হাঁটু ঝুলের ড্রেস, কোনওটা ফ্রিল বসানো মিনি স্কার্ট। আর এক রঙের শার্ট বা কোট ড্রেস এই সময়টায় বড় বাঁচা বাঁচায়। একে তো ওগুলো হাঁটুর ওপরেই শেষ, তা ছাড়া শরীরকে চেপে ধরে না মোটেও। আলগোছে ছুঁয়ে থাকে শুধু। জল পড়লে গায়ে সেঁটে বসে বিপাকে ফেলে না। প্রসঙ্গত, এ সময় একটি শখকে কিন্তু তুলে রাখতেই হবে। সাদা কটন পরে আরাম করা আর শৌখিন থাকা। ওটি পরে বৃষ্টিতে ভিজলেই সর্বনাশ। কিংবা মন্দাকিনী।
সিনেমার প্রসঙ্গ যখন উঠলই, তখন আর একটা সাবধানবাণী শুনিয়ে রাখি। সিল্ক বা শিফনের শাড়ি পরে স্মিতা পাটিল বা রবিনা টন্ডন হওয়ার ইচ্ছেটাও বাস্তবে বুমেরাংসম হয়ে যেতে পারে। বর্ষা কখন টিপটিপ থেকে ঝমাঝমঝম হয়ে যাবে কে বলতে পারে? তখন সে সব শাড়ি আপনাকে কাঁদিয়ে ছাড়বে। ভিজে চুপ্পুস, ওজনে তিনগুণ, ভারী অস্বস্তি ওর মধ্যে বর্ষার সমস্ত বদগুণ রমরম করে উপস্থিত। বরং অ্যাকসেসরিতে ফিল্মি হোন যত খুশি। আশির দশকের শ্রীদেবীর সেই বিখ্যাত বাবল আমব্রেলা, ট্রান্সপারেন্ট রেনকোট অ্যাদ্দিনে কলকাতায় এসে পৌঁছেছে। রাস্তা ধার থেকে ব্র্যান্ডেড আউটলেট, সবখানেই আছে। জায়গা বিশেষে স্টাইলের তফাত বিশেষজ্ঞের চোখেই ধরা পড়বে। তবে রাস্তারটির আয়ু বড় জোর তিন পশলা। তবে এই ফ্যাশনটিকে ছেলেমানুষি মনে করেন অনেকেই। তাঁরা বরং খুঁজে নিন থ্রি-ফোল্ড ফোর ফোল্ড ছাতাদের। তাতে আজকাল বাগান-ছাতার নকশা দেখা যায়। খুললে রামধনু, কিংবা রঙের ফোঁটা ছড়ানো, বা সেই গোল গোল ববি প্রিন্ট।
বৃষ্টির জুতো নিয়ে তাক ভর্তি রেন কালেকশন পাবেন। গাম বুট তো আর সমতল বা শহরে চলে না। তার জন্য ফ্লোটারস বা ওয়াটারপ্রুফ রাবার স্নিকার্স, স্যান্ডাল রয়েছে বিস্তর। এই সব অ্যাকোয়া স্যান্ডাল বা পাম্প খেয়াল করে কিনলে ভাল। কারণ অনেক সময়ই এগুলিতে পা কেটে যায়। রাস্তা পিছলও হতে পারে, তাই স্যান্ডেলের স্ট্র্যাপ শক্তপোক্ত হওয়া খুব জরুরি। ক্রকস জুতোর বিশাল আকৃতি দেখে অনেকেই আঁতকে ওঠেন। তারও এখন কিছু কিছু ফ্যাশনেবল চেহারা চোখে পড়ে। তবু খুব ফাঙ্কি মেজাজের না হলে নিজেও পরলে স্বস্তি পাবেন না।
ছেলেদের বর্ষা পোশাকে আবার একটু নাবিক নাবিক আদল রয়েছে। নামও সেলর প্যান্টস। আর কালো ছাতার বদলে রেনকোটটাই ওদের বেশি মানায়। ওয়াটারপ্রুফ ব্যাকপ্যাক সঙ্গে রাখলে রেনকোট রাখার চিন্তাও থাকবে না। আর ফ্লোটার্স, স্নিকার্স, কিটোস-এই সময়টা কাটিয়ে দিন। চামড়ার জুতো যত এড়িয়ে চলা যায় তত ভাল। ওতে জল বসে জীবাণুর উপদ্রবের সম্ভাবনা। খারাপ আবহাওয়ার জন্য তৈরি ব্র্যান্ডেড জুতোগুলোই এ সময়ের জন্য সেরা।
কিন্তু, কলকাতা ক’দিনই বা বৃষ্টিশহর হয়? তাই যে ক’টা দিন পাব, সব আশ মিটিয়ে মেঘদূত আর জলকন্যা সাজব। জল জমুক ভাঙা ট্রামলাইনে, ফ্লাইওভারের খোঁড়াখুঁড়ির গর্তে, ময়লা ঢেউ উঠুক সেন্ট্রাল এভিনিউতে। তবু আমরা ছুটে বেরোব ওই জলের ধারা মাঝে। কী করি, এ শহর আজও বৃষ্টিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে শেখেনি। তাই, আশ মেটাতে নিজেদেরই বৃষ্টিবাসে প্রস্তুত করে তুলব। এ ভাবেই হোক আমাদের বর্ষাবরণ। কই? তুমি কি কিছুই শুনলে না, আকাশ? |
|
|
|
|
|