বারোটার মধ্যে প্যারেড শেষ
র্ধ্বগগনে বাজে মা...ভ্যাম, নিম্নে উতলা ধরণী...ভ্যাম না, কোনও প্রিন্টিং মিসটেক নয়। পনেরো অগস্ট সক্কাল সক্কাল যে প্রভাতফেরি আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেত, তাতে এই গানটার সঙ্গে ব্যান্ডের যে সব বাজনা বাজত, তার মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল বড় চোঙাওয়ালা মুখের শিঙার। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। আমরা ছুট্টে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতাম। আর ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণীতল-এর শেষ দল ও তল-এর সময় সজোরে শিঙার আওয়াজটা এসে পড়ত। আর আমাদের বাড়ির বছর পাঁচেকের ছেলের কাছে গানটার লিরিক বদলে গিয়ে সব লাইনের শেষে অন্তত খান দশ ‘ভ্যাম’ এসে জুড়ে যেত।
তার পর হইহই করে বসে যেত সিঙাড়া-জিলিপির হাট, আমাদের জলখাবারের আড্ডায়। বাড়িময় খুশি খুশি ভাব। এবং বাবার ছুটি, যেটা আমাদের কাছে বর্ষার চাতকের মতোই কাম্য ছিল। তবে আমাদের যে পুরো ছুটি থাকত তা নয়। বেলা বাড়তে না বাড়তে স্কুলের পনেরোই অগস্ট মানাতে আমি আর দিদি গুটিগুটি স্কুলের দিকে হাঁটা। কোনও বছর প্যারেড, কোনও বছর নাচ, কোনও বছর গান, আবার কোনও বছর কেবল স্পোর্টস ড্রেস পরে ইন সলিডারিটি সবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা। বারোটার মধ্যে স্কুলের পাট মোটামুটি চুকে যেত। বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে হয় কারও বাড়ি যাওয়া নয়তো বহু লোকের আমাদের বাড়িতে আসা টিংটং বেল বাজিয়ে। তাই বাড়ি গমগম। জ্যাঠা-পিসিদের সঙ্গে বংশতালিকার নিম্ন-স্থানাধিকারীদেরও একটা গেট-টুগেদার।
বাবারা অবশ্যই গল্পে ফিরে ফিরে যেত স্বাধীনতার আগে ওদের ঢাকা-পাবনার দিনগুলোয়। আমার দাদু খাঁটি বর্ধমানের মানুষ, তখন চাকরি সূত্রে ঢাকায় পোস্টেড ছিলেন। আর জ্যাঠা-পিসিদের গল্পে সেই থরথর কাহিনি ‘বাপ্পাদিত্য’ গল্পের মাদকতায় আমাদের কাছে ফিরে আসত। বাবা যেহেতু নেহাতই ছোট ছিল দেশভাগের সময়, তাই বিশেষ পাত্তা পেত না। কিছু ক্ষণ পরে অবশ্য উত্তম-সুচিত্রা, দুর্গাদাস-অহীন্দ্র চৌধুরী নিয়ে প্রবল তর্ক কিংবা এক বার পুজোর সময় পুলিশ ভ্যানে করে কী করে সবাই বাড়ি ফিরেছিল, সেই গল্পও হত। সভা অন্তে, বুকে বেশ একটা ফুরফুরে ভাব নিয়ে আমরা ঘুমোতে যেতাম। একটা নির্মল স্বাধীনতা দিবস শেষ হয়ে যেত।
আমাদের ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ি। বাবার এক সম্পর্কের দাদা ছাড়া কেউ স্বদেশি হয়নি। দাদুর হুকুমে সুতির জামাকাপড় পরার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু বাড়িটা, স্বদেশিমনস্ক হলেও, বিরাট কট্টর স্বাধীনতা-আন্দোলন টাইপ ছিল না। তার পর আর পাঁচটা বাড়ির মতোই আমাদের বাড়িটাও গড়ে উঠেছিল। আদ্যোপান্ত মধ্যবিত্ত। তাই পনেরোই অগস্ট একটা অন্য ছুটির দিনের আমেজই থাকত। আলাদা করে দেশ আর দেশের মানুষ, বা নিজের এবং অন্যের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি আলাদা করে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠার কোনও সেমিনার আমাদের বাড়ি বা আত্মীয়দের মধ্যে ছিল না।
এ ধরনের কথা শুনলে আমাদের বাড়িটাকেই বোধ করি অশিক্ষিত বলা হবে। কিন্তু আমি জানি, যাঁরা বলবেন, তাঁদের বাড়িতেও হয়তো স্বাধীনতা দিবস ছুটির দিন বলেই পালিত হয়। আর আমি অন্তত এতে কোনও দোষ দেখি না। সব্বার এখন বেজায় রাগ হয় দেখি একটাই কারণে ‘অশিক্ষিতের’ মতো দ্যাখো হইচই করে বেরিয়ে পড়েছে, মল-এ যাচ্ছে, গাঁইগাঁউ করে রোল-চাউমিন খাচ্ছে, সিনেমা দেখছে কোনও কালচার নেই।
কিন্তু একটা কথা বলুন তো, কেনই বা লোকে নিজেদের মতো ছুটির দিন যাপন করবে না পনেরোই অগস্ট? কেনই বা একটা দিন খুব উদ্বুদ্ধ থাকতে হবে দেশের প্রতি? কেনই বা একটা দিনে আমরা ‘স্বাধীনতার আসল মানে’ নিয়ে ভূরি ভূরি আলোচনা আর গলা
নামিয়ে গান করব? আর পাঁচটা ছুটির দিনে যদি হ্যালালালা করে চেটেপুটে মজা করি, তো পনেরো তারিখ কেন নয়?
আর যদি এ দায়িত্ব দেশের নাগরিক হিসেবে আমার মাথায় খাঁড়ার মতো ঝোলে, তা হলে তো দেশেরও উচিত ছিল আমার স্বাধীনতা, আমার অধিকারের প্রতি খেয়াল রাখা। আর কোনও দিন না হোক, দেশ কি স্বাধীনতা দিবসের দিনটাতেও তার নাগরিকদের খেয়াল রাখে? তাদের অধিকার, তাদের অসুবিধে, তাদের মুক্তচিন্তা, তাদের ইচ্ছে, তাদের স্বাধীনতার মর্যাদা দেয়? না কি, লাল কেল্লার পতাকায় আর কিছু ক্ষণের বক্তৃতায় চকচকে হয়ে ওঠে জাতির ভবিষ্যৎ আর নিমেষে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীনতার প্রতিটি অঙ্গীকার?
কিন্তু আমি কি নিতান্তই ইতর আর নরাধম যে, যে লোকগুলো কষ্ট করে, রক্ত বইয়ে এই স্বাধীন মাটিটা আমায় গিফট র্যাপ করে দিয়েছে, যে মাটিতে দাঁড়িয়ে আমি বড় বড় বুকনি মারছি, তাঁদের প্রতি তাঁদের কাজের প্রতি আমার কোনও শ্রদ্ধা নেই বা আমি মনে করি না তাঁদের এই দিনটিতে বা বাকি দিনগুলোয় স্মরণ করা উচিত বা শ্রদ্ধা জানানো উচিত? সেই অনুভব আমার ভেতরে থাকলেও আমি তার বহিঃপ্রকাশ করি না, কেন না একটা বড় মাপের ঔদাসীন্য এসে আমাকে জাপটে ধরে। স্বাধীনতা চলে গেছে কতগুলো কুড়ি কুড়ি বছরের পার, অথচ এই দেশটা আমার সম্মান আদায় করতে পারেনি, আমায় দেশের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি, আমায় এমন কোনও লক্ষ্য দেখাতে পারেনি যে জন্য আমি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি, এমন একটা পরিবেশ দিতে পারেনি যেখানে আমার নির্ভীক ইচ্ছেগুলো আলো-হাওয়া পেতে পারে। ১৫ অগস্ট আমি বুক বাজিয়ে বলতে পারি না যে, আজ আমার দেশের স্বাধীনতা দিবস, আজ কোনও মহৎ চালাকি নয়। যারা নিজেরা আর্মিতে যায়, যারা গরিবের দুঃখে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারা নিশ্চয়ই খুব ভাল, তারা দেশের পরোয়া করার জন্য বসে থাকে না। কিন্তু আমি সাধারণ, নিউটনের তৃতীয় সূত্র মেনে চলি। দেশ আমার প্রতি উদাসীন এবং উল্টোটাও সত্যি।
তবু, যদি আমরা মন দিয়ে আজ স্বাধীনতা দিবস গুরুগম্ভীর ভাবে পালনও করি, তা হলে একটা দিনের জন্যও কি পিঙ্কি প্রামাণিক তার লিঙ্গের সত্যতা কেবল নিজের মধ্যে রাখতে পারবে? ছোট স্কার্ট পরা মেয়েরা স্বাধীনতা দিবসের দিন যৌন হেনস্থার শিকার হবে না? হিজড়েদেরও আমরা মানুষ বলে মনে করব? নিম্নবর্ণের মানুষ কি গ্রামের বড় কুয়ো থেকে জল নিতে পারবে? এক জন সাধারণ বউ কি বলতে পারবে যে আমিও সারা বছর খাটি, আজ আমায় স্বামী চা করে দিক? খাপ-পঞ্চায়েত সমৃদ্ধ এলাকার একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে কি নিজেদের পছন্দ মতো বিয়ে করতে পারবে, কেবল তারা একে অপরকে ভালবাসে বলে? পারবে না। আপনিও জানেন, আমিও জানি।
যখন জানি এর কোনওটাই ঘটবে না তখন কেন খামখা হৃদয় খুঁড়ে বেদনা ঢুঁড়ে মাথা জ্বালিয়ে ঠোঁট টিপে মুঠো বাগিয়ে রাগ চাপতে চাপতে দিনটা পালন করা?
তার চেয়ে আসুন, অম্লানবদনে ভুলে থাকি স্বাধীনতার আই-ওয়াশ। মস্তিষ্ককে এই সব খোঁচা থেকে দিয়ে দিই লম্বা ছুটি, হইহই সহযোগে মানাই আগামী ছুটির দিনটি: পনেরোই অগস্ট।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.