|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
হেলায় হারাচ্ছি তরুণের স্বপ্ন |
আশিস পাঠক |
সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ: বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি, সম্পাদনা: আনিসুজ্জামান। বিশ্বভারতী, ৭৫০.০০
পুনশ্চ রবীন্দ্রকৃতি,
প্রধান সম্পাদক সব্যসাচী ভট্টাচার্য, যুগ্ম সম্পাদক ব্রতীন দে। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ১৯০.০০ |
শান্তিনিকেতনে একটা গোরুর গাড়ির চাকা কাদায় বসে গিয়েছে। ব্রহ্মবিদ্যালয়ের ছাত্রেরা সবাই মিলে উৎসাহের সঙ্গে গাড়িটাকে টেনে তুলল। কাজের আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার এই ছবিটা দেখে ধীরেন্দ্রমোহন সেনকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এই আমন্ত্রণ ইকনমিকসে ডিগ্রি নেওয়ার নয়, চরিত্রকে বলিষ্ঠ কর্মিষ্ঠ করায়, সকল অবস্থার জন্যে নিপুণভাবে প্রস্তুত করায়, নিরলস আত্মশক্তির উপর নির্ভর করে কর্মানুষ্ঠানে দায়িত্ব সাধনা করায়, অর্থাৎ কেবল পাণ্ডিত্যচর্চায় নয়, পৌরুষচর্চায়।’
বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রচর্চার মোটামুটি গত একশো বছরের ইতিহাসে ওই শেষ দুটো শব্দ বড় গুরুত্বপূর্ণ। ‘পাণ্ডিত্যচর্চা’ আর ‘পৌরুষচর্চা’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নিছক তথ্য আর জ্ঞানের ভাণ্ডার যদি এই সার্ধশতবার্ষিক রবীন্দ্রচর্চায় ক্রমেই উপচীয়মান হতে থাকে তবে তার তুলনায় স্পষ্ট করে বলা কাজের কথা, বোধের কথার ভাণ্ডার নিতান্ত শূন্যই। কবি-ঔপন্যাসিক-ছোটগল্পকার-সাহিত্যসমালোচক-নাট্যকার-চিত্রশিল্পী-সংগীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের বাইরে (কিংবা হয়তো ভেতরেই) যে কর্মী রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথা সে ভাবে কেউ বললেন না। ভারতের দুটি প্রধান সরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রদ্ধার্ঘ্যে সেই কাজের কথার ভাণ্ডার আর একটু ভরে উঠবে, আশা ছিল। তাই, সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ: বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি-র সূচিপত্রে যখন দেখা গেল দ্বিতীয় প্রবন্ধের নাম ‘রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন-স্বর্গ’, তার পরেই ‘রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন: ভাবনায় ও কর্মে’ কিংবা তারও পরে ‘রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ’ তখনই মনে হয়েছিল এ বই একটু অন্য পথে হাঁটবে। বিশেষত বাংলায় লেখালেখির যে ভূখণ্ডটির সঙ্গে সাধারণ বাঙালির পরিচয় কমই থাকে তার রবীন্দ্রচিন্তায় এই ব্যাপকতর পরিপ্রেক্ষিত ভাল লেগেছিল। এই সংকলনে চর্বিতচর্বণের পাশে দু’-একটি নতুন আলোর রেখার মধ্যে উল্লেখ্য সনজীদা খাতুনের ‘বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সাথি’, ভীষ্মদেব চৌধুরীর ‘উত্তমপুরুষের গল্প’ এবং আবদুশ শাকুরের ‘রবীন্দ্রনাথের আত্মপরিচয়’। শেষোক্তটিতে আত্মপরিচয়-এর প্রবন্ধ-বিন্যাস বদল করে যে ভাবে নতুন প্রতর্ক তৈরি করে তুলতে চেয়েছেন প্রাবন্ধিক তা চিন্তার খোরাক জোগায়।
তবু, ছক-ভাঙা চিন্তার তেমন নজির এই সংকলনে মিলল না। ‘পৌরুষচর্চা’র যে-অভাব গত শতাব্দ ধরে টাকও-হয়-টিকিও-হয় গোছের বৃত্তাকার চিন্তায় অধিকাংশ রবীন্দ্রচর্চাকে ঘুরিয়ে চলেছে তা থেকে বেরনো গেল না। করুণাময় গোস্বামীর ‘রবীন্দ্রসংগীতের অনন্যতন্ত্রতা’ জানাচ্ছে, ‘রবীন্দ্রনাথের সাংগীতিক সৌন্দর্যতত্ত্বের প্রধান কথাটি হচ্ছে সুর ও বাণীর সম্মিলন, যেন সাহিত্যের ভূমিতে উৎপন্ন গান সুরের আকাশে গিয়ে যথার্থভাবে প্রকাশিত হতে পারে।... রবীন্দ্রনাথ সীমা-অসীমকে মিলিয়ে দাঁড়ান তাঁর রচনায়।’ কিন্তু যে সব গানে সুর আগে এসেছে, কথা পরে, তাদের ক্ষেত্রে কী হবে? তা ছাড়া, কথা সীমিত, সুর অসীম, এ ভাবে ভাববই বা কেন? সম্মিলন নয়, এক একটি অখণ্ড পূর্ণ সংগীতসৃষ্টি হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ভাবা যায় না?
কোনও কোনও প্রবন্ধ আবার মাছের তেলেই মাছ ভেজেছে। যেমন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন-স্বর্গ’। প্রায় ২৫ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধের ২৪ পৃষ্ঠাই রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে উদ্ধৃতি। যেটুকু প্রবন্ধকারের নিজের তার মধ্যেও নিছক চিঠির সন-তারিখ আর বিবরণ ছাড়া কিছু নেই।
সম্পাদক ঠিকই লিখেছেন, ‘লেখক-তালিকা দেখলে বইটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রবন্ধ-সংকলন বলে বিবেচিত হবে।’ এই মুহূর্তে বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নতুন কী ভাবছে সেটা জানতে পারাই এ বইয়ে প্রত্যাশিত ছিল। তা অনেকাংশে মিটেছে, বলতেই হয়। তবে সম্পাদক প্রবন্ধগুলির ভাষার গতিময়তা রক্ষায় আর একটু যত্নবান হলে প্রয়োজন আর একটু স্বচ্ছন্দে মেটানো যেত। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন সংগ্রহ থেকে নেওয়া ১৪ জন শিল্পীর রবীন্দ্র-প্রতিকৃতির বৈচিত্র্য এবং তারুণ্য পড়ার কষ্টের মাঝে মাঝে কিছুটা দেখার মুক্তি দিয়েছে।
বিষয়ের বৈচিত্র্য পুনশ্চ রবীন্দ্রকৃতি-তেও লক্ষ করার মতো। চিরাচরিত বিষয়ের পাশে সব্যসাচী ভট্টাচার্যের ইংরেজি বইয়ের আংশিক অনুবাদ ‘সভ্যতা: রবীন্দ্রনাথ-এর চিন্তার বিবর্তন’ বিশেষ উল্লেখ্য। এ প্রবন্ধ গাঁধীর ‘হিন্দ স্বরাজ’ আর নেহরুর ‘ভারত আবিষ্কার’-এর পাশে রবীন্দ্রনাথের ভারতীয় সমন্বয়ধর্মী সভ্যতার ধারণাকে স্পষ্ট করেছে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ‘বাঁশির ধারেই একটু আলো’, সুপ্রিয় ঠাকুরের ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শন’ কিংবা অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায়ের ‘গীতিসুধা রসে রবীন্দ্রনাথ’ বার বার পড়ার মতো। মুনতাসীর মামুন যথেষ্ট দেরি করে মূল প্রসঙ্গে ঢুকলেও তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ’ বিষয়টির গভীর আলোচনা। মামুন তাঁর প্রবন্ধ যে ভাবে শুরু করেছেন সেটি, অন্তত ভারত সরকারের অধীন কোনও স্বশাসিত প্রকাশনা-সংস্থার বইয়ে চমকে দেয়: ‘‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ— বাংলাদেশে, রবীন্দ্রনাথের আসন কেন অনন্য, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। ‘উঠতেই পারে’ শব্দ দু’টি ব্যবহারে সাম্প্রদায়িকতার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত অনেকে পেতে পারেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান সেটি চাদর চেপে রাখা অর্থহীন।’’ সম্প্রদায়ের দিক থেকে না দেখে প্রশ্নটি ভাষার দিক থেকেও কিন্তু বিচার করা যেত।
চিন্তার নতুন আলো, দুটি বইয়েই, ক্ষীণ হলেও অলক্ষ্য নয়। কিন্তু একটি অশনি সংকেতও স্পষ্ট। দুটি বইয়ের মোট ৩৮টি প্রবন্ধের মধ্যে ৩১টিরই লেখকের বয়স ৬০ বা তার বেশি। পাঁচটির ৫০ বা তার বেশি। হাতে রইল দুই, তার এক জন ৪০ পেরিয়েছেন, এক জন তার নীচে। চল্লিশ পেরোলেই মুক্তদৃষ্টিতে চালসে পড়ে কিংবা চিন্তকেরও অবসরের বয়স ৬০, সে কথা বলছি না। কিন্তু এমত দুটি রবীন্দ্র-শ্রদ্ধাঞ্জলিতে তরুণ প্রজন্মের মাত্র এক জনেরই ঠাঁই হয়েছে, এই তথ্যটি ভাবাচ্ছে। আর সেই তরুণ, ব্রতীন দে-রও অবদান চিন্তার ক্ষেত্রে নয়, রবীন্দ্রজীবনের ও রচনার কালক্রম তৈরি করে দেওয়ার নিতান্ত মজুরগিরিতে!
ভয় হয়, পাণ্ডিত্যে ওজনদার নামের মোহে রবীন্দ্রচর্চায় তরুণের স্বপ্ন, সন্ধান আর দুঃসাহসী পৌরুষকে আমরা হেলায় হারাচ্ছি না তো? |
|
|
|
|
|