|
|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
হিমের রাতে...
প্রথম প্রেমের মতো কাঁপন তুলে হঠাৎ হাজির এক সুন্দরী ঝরনা।
এত কষ্টেও মনে অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছিল।
লিখছেন অঞ্জন সরকার |
|
কলকাতা থেকে লখনউ। রাতটা কোনও রকমে কাটিয়ে পরের দিন সন্ধ্যার ট্রেনে হলদোয়ানি। পৌঁছলাম পরের ভোরে। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ধরে পরের গন্তব্য ভারারি। কাঠগোদাম, আলমোড়া, কৌশানি, বাগেশ্বর হয়ে সন্ধ্যায়...। যাত্রাশেষে ঘড়ি বলছে, রাত প্রায় আটটা। লোডশেডিং, কনকনে ঠান্ডা, ঘুটঘুটে অন্ধকার। এক সহৃদয় ভদ্রলোকের সাহায্যে পৌঁছলাম হোটেলে। ছাদখোলা বাথরুমে হাতমুখ ধুতে গিয়ে অন্ধকারে বালতির জলে দেখি, ভাসছে ছোট ছোট সাদা ন্যাপথালিনের মতো বরফের টুকরো। বুঝলাম, পিন্ডারির পথে অভ্যর্থনাটা খারাপ হবে না। পরের দিন সকালে দেখি, কালকের সেই বাস। চলেছে সোং, ভারারি থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার। সরযূ নদীর ধার দিয়ে ন্যাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে রাস্তা। |
|
এ বার হাঁটা শুরু। চড়াই ভেঙে প্রায় তিন কিলোমিটারের মাথায় উঠে এলাম লোহারখেত। বাংলোটা পিছনে ফেলে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা, শুধু চড়াই আর চড়াই। মনে হচ্ছিল জীবনে উতরাইটা বোধ হয় হারিয়েই গেছে। মাঝে এল বৃষ্টি। সোনায় সোহাগা আর কী! ঠান্ডায় যেন হাড়ে হাড়ে কনসার্ট হচ্ছে। কাঁপতে কাঁপতে হাজির হলাম ঢাকুরিতে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বাংলো ‘হাউসফুল’। খোলা মাঠে তাঁবুর মাটিতে ঘুমথলিতেই (স্লিপিং ব্যাগ) রাত শেষ।
পরের ভোরের আলোটা এত ভাল লাগছিল! সকালবেলায়, বেশ সকালবেলাতেই চলা শুরু করলাম। নাম-না-জানা পাখির ডাকে মন ভরিয়ে, দু’ধারে রডোডেনড্রন গাছ, ফুল-বিছানো পথ...উঁচু উঁচু পাইনের জঙ্গলে ঘন সবুজ মস্দের সঙ্গে নিয়ে ভাঙাচোরা ঝুপড়ি চায়ের দোকানের ফাঁক দিয়ে এক টুকরো নীল আকাশকে বুকে করে রাখা একচিলতে জল...তার পাড় ধরে টকটকে লাল রামদানার ওড়না বিছানো...পৌঁছলাম খাতি। একটু বিশ্রাম, স্থানীয় দোকানের জলখাবার, তার পরে আবার চলা। পিন্ডার ঝাঁপিয়ে এল তার তীব্র স্রোত নিয়ে। ঘন বনের স্যাঁতসেতে অন্ধকার। পার হলাম একটা কাঠের পুল। |
|
প্রথম প্রেমের মতো কাঁপন তুলে হঠাৎ হাজির এক সুন্দরী ঝরনা। এত কষ্টেও মনে অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছিল। দুপুর দুপুর পৌঁছলাম দেয়ালি। আজ এখানেই থাকব। দেয়ালিতে বরফ-ঢাকা পাহাড়চূড়ায় সূর্যাস্তের রং ভুলব না কখনও। রাতে পিন্ডার নদীর গান শোনাতে শোনাতে এল ঘুমপরিরা।
স্বপ্নশেষে একটানা খাড়া চড়াই ভেঙে পরের দিন সকালে চলা শুরু। মাঝে পেলাম একটা ঘাসজমি, তার পরে একটা আইসফিল্ড পার করে পৌঁছলাম ফুরকিয়া। আজ বেজায় আলসেমিতে পেয়েছে। আস্তানা গাড়লাম ফুরকিয়ায়। দুপুরে গরম ভাত, আলুসেদ্ধ আর মাখন। এ কদিন না স্নান, না জামাকাপড় পালটানো...একেবারে বোহেমিয়ানার চূড়ান্ত! বিকেলশেষে বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দিনশেষের আকাশে চাঁদ উঠেছে, যদিও দিনের আলো এখনও প্রচুর। নীচে পিন্ডার বয়ে চলেছে, বিরামহীন...কয়েকটা ‘হিমালয়ান থর’ নদী পার হচ্ছে...মেঘ জমছে অল্প অল্প...কনকনে বাতাস আমার গা মুছিয়ে দিচ্ছে...হাওয়ায় বুক ভাসিয়ে যাওয়া ‘স্নো-পিজিয়ন’দের পথে চোখ রেখে আমার দৃষ্টি হারিয়ে যাচ্ছে কোথায়! |
|
পরের দিন ভোর ভোর হাঁটা শুরু। সবুজ উপত্যকায় রডোডেনড্রন, বরফগলা মাটিতে সদ্য মাথা-তোলা ছোট ছোট গাছেরা...ঝলমলে রোদ...আমি চলেছি হিমবাহের দিকে। খুব আনন্দ হচ্ছিল। কষ্ট? একটুও নেই। নদী পার হলাম এক বিস্তৃত উপত্যকার মধ্য দিয়ে। কত কত বরফ-ঢাকা পাহাড়চুড়ো! নন্দাকোট, নন্দাখাত, ছাঁকুচ, বালজোরি, আরও আরও অনেক। মন দিয়ে তাদের ছুঁয়ে চলতে চলতে এসে পড়লাম পুন্ডারি হিমবাহের ‘জিরো পয়েন্টে’। অনেক উঁচু থেকে হিমবাহ নেমে এসেছে। কী বিশাল, কী আশ্চর্য উদার! হিমবাহ থেকে বেরিয়ে এসেছে পিন্ডার নদী, গেরুয়া রঙা। দু’পাশে পাহাড়, পাথরের আর মাটির। বরফে কেমন অদ্ভুত একটা নীলচে সবুজ রং, যেন নীলকান্ত মণি! খুব ছোটবেলায় রূপকথার বইয়ে পড়েছিলাম, আজ তাকে প্রত্যক্ষ করলাম। অনেকটা সময় বসে ছিলাম সেখানে। তার পরে ফিরতেই হল উজানে!
|
কী ভাবে যাবেন |
কলকাতা থেকে কাঠগোদাম পর্যন্ত ট্রেনের টিকিট কাটুন। কাঠগোদামের আগের স্টেশন
হলদোয়ানিতে নামুন। হলদোয়ানি থেকে বাসে ভারারি হয়ে সোং। সোং থেকে হাঁটা শুরু।
পিন্ডারি হয়ে ফেরার পথে দেয়ালিতে এক রাত থেকে কাফনি হিমবাহও দেখে নিতে পারেন। |
কখন যাবেন |
মার্চ থেকে মে এবং অক্টোবর-নভেম্বর ভাল সময়। |
কোথায় থাকবেন |
গোটা পথেই সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বাংলো ও হোটেল আছে। |
মনে রাখবেন |
প্রয়োজনীয় ওষুধ, টর্চ, শীতের জামাকাপড়, টয়লেট পেপার সঙ্গে রাখুন। |
|
|
|
|
|
|
|