ভবিতব্যের মোড় ঘুরিয়ে জীবনের জয়গান
রূপকথার প্রত্যাবর্তন, তবু রইল প্রশ্ন
রোম্যান্স বনাম শারীরবিজ্ঞান।
রূপকথা বনাম রূঢ় ক্রিকেটীয় প্রশ্ন।
আবেগ বনাম যুক্তি।
ন’মাস পরে ক্যানসারাক্রান্ত যুবরাজ সিংহের ভারতীয় ক্রিকেট দলে রোমাঞ্চকর প্রত্যাবর্তন অভূতপূর্ব বিভাজন ঘটিয়ে দিল ভারতীয় ক্রিকেটে। এমনকী তাঁকে ছাপিয়ে দেশজ সমাজজীবনেও। মুম্বইয়ে শুক্রবার দুপুরে শ্রীকান্তের নেতৃত্বাধীন কমিটির নেওয়া সিদ্ধান্তের রেশ সমান্তরাল ভাবে তাড়া করল ভারতীয় চিকিৎসক জগতকেও। টিভি স্টুডিও থেকে কাগজের অফিস ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের কাছে ফোন এল এবং গেল। যে ভাবে সল্টলেক স্টেডিয়ামে বড় ম্যাচের দিন ফুটবল বিশেষজ্ঞদের কাছে যায়।
নির্বাচনী বৈঠকের শিরোনাম হওয়ার কথা ছিল মহেন্দ্র সিংহ ধোনির। ০-৮ হেরে আসা অধিনায়ককে জাতীয় নির্বাচক কমিটি নিষ্কৃতি দেয় কি না? এর পিঠোপিঠি ছোট জিজ্ঞাসা। ভিভিএস লক্ষ্মণকে তাঁর বন্ধু দ্রাবিড়ের রাস্তায় ঠেলে দেওয়া হবে কি না?
রূপকথার এমনই মাদকতা, সে সব পেছনে চলে গেল। মিডিয়ার গোটা মনোযোগ এবং দেশের সমস্ত ওবি ভ্যান যেন যুবরাজের বাড়ির বাইরে। যেখানে আবেগে আপ্লুত হয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলছেন, “অবিশ্বাস্য লাগছে। মনে হচ্ছে দেশের হয়ে প্রথম খেলতে যাচ্ছি।” অভিভূত ক্রিকেট সার্কিটে তাঁর সব বন্ধুরাও। শেন ওয়ার্ন থেকে কেভিন পিটারসেন। এফএম শো-এ, টেলিভিশনে, সর্বত্র যুবরাজ। গোটা দেশের রাজপথেও যেন তাঁকে ঘিরে এখন অদৃশ্য হোর্ডিং এ ভাবেও ফিরে আসা যায়! শ্রীলঙ্কায় আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে প্রত্যাবর্তনের আগে যুবরাজ ভারতের হয়ে শেষ মাঠে নেমেছিলেন ইডেন টেস্টে। সেই গত নভেম্বর মাসে। ন’মাস বাদে ক্যানসারের সঙ্গে তীব্র যুদ্ধের পর রোমহর্ষক প্রত্যাবর্তন ত্যুর দ্য ফ্রান্স ও আর্মস্ট্রংকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
আবেগের এই হিমশৈলে কর্কশ কিছু প্রশ্ন কিন্তু ঢাকা পড়ছে না। বরং রূপকথার মুখোমুখি রূঢ় বাস্তবের মতো মাটি ফুঁড়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাৎপর্যপূর্ণ বিভাজন ঘটিয়ে দিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটমহলে। অভ্যর্থনার পিঠোপিঠি এখন গভীরতর আশঙ্কা যে, এর ফলে বিশাল শারীরিক ঝুঁকির সামনে পড়ে যেতে পারেন যুবরাজ! ভুরু কোঁচকানো শুরু হয়েছে, যে পদ্ধতিতে তাঁকে নির্বাচন করা হল তা নিয়েও। যেখানে না দেখা হয়েছে ফিটনেস, না ফর্ম। নির্বাচকেরা জানাচ্ছেন, আর পাঁচটা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ফিটনেসের যে ছাড়পত্র তাঁরা অনুসরণ করেন, এখানেও তাই হচ্ছে। ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমির ফিটনেস সার্টিফিকেট দেখে তবেই তাঁকে নেওয়া হয়েছে। এখানেই ক্যাটক্যাটে প্রশ্নটা, এনসিএ-র ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়ে কেন যুবরাজকে ফেরানো হবে? তাঁর তো মাস্ল পুল বা হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট হয়নি। হয়েছে ক্যানসার। বোর্ড কেন কোনও ক্যানসার বিশেষজ্ঞের রিপোর্ট যুবরাজের জন্য তৈরি করাল না?
যুবরাজ যাঁর ভাবশিষ্য বলে ক্রিকেট সার্কিটে পরিচিত, অসুস্থ হওয়ার পর যাঁর সঙ্গে তাঁর প্রতিনিয়ত যোগাযোগ, সেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, তিনি “ঘোর বিস্মিত। এত বড় একটা রোগ হওয়ার পর এত তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে নেওয়া হল!” ভাষ্যকার হিসেবে সব সময়ই যিনি অবিতর্কিত থাকতে চেয়েছেন, সেই হর্ষ ভোগলে অবধি বলে ফেললেন, “পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, যুবরাজের নির্বাচনে যুক্তির চেয়ে আবেগ অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। পৃথিবীর আর কোনও দেশ ওকে বাছত না।”
শুক্রবার মুম্বই থেকে ফোনে এক নির্বাচক বললেন, “সিদ্ধান্তটা সর্বসম্মত। কিন্তু মেনে নিচ্ছি, ক্যালকুলেটেড রিস্ক। টেস্ট ম্যাচে পাঁচ দিন ওকে খেলানোর প্রশ্ন ওঠে না। কুড়ি ওভারের ম্যাচে ঝুঁকি নেওয়াই যায়। যুবির একটা ইনিংস টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের রং ঘুরিয়ে দিতে পারে।” কোনও ক্যানসার বিশেষজ্ঞের রিপোর্ট পেলে তাঁদের সুবিধে হত মেনে নিয়েই নির্বাচক বলছেন, “আরও এক মাস সময় ও পাচ্ছে সুস্থ হওয়ার জন্য।” যুবরাজ নিজে উচ্ছ্বসিত। বোর্ডকর্তা, নির্বাচক, মিডিয়া সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি নিজে সবচেয়ে ভাল জানেন, দলে ফিরলেন বোর্ডকর্তাদের হস্তক্ষেপে। বোর্ডকর্তারাও চেয়েছেন রূপকথাকে সত্যি করে মানবের এই অসাধারণ প্রত্যাবর্তনকে সম্মান জানাতে। সমস্যা হল, তাঁদেরই মধ্যে কেউ কেউ আবার অশনিসঙ্কেত দেখছেন। এ দিন দল নির্বাচিত হওয়া থেকে শুরু করে বিশ্বকাপ পর্যন্ত কোনও ক্রিকেটার যদি আহত না হয়ে নিছক অসুস্থ হয়ে পড়েন, তা হলে তাঁর বিকল্প আইসিসি দেবে না। অর্থাৎ কোনও কারণে যদি মধ্যবর্তী সময়ে শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন যুবরাজ, তা হলেও টিমের সঙ্গে কলম্বো যেতে হবে। তাঁর পরিবর্ত পাওয়া যাবে না।
কলকাতার ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডক্টর গৌতম মুখোপাধ্যায় বলছেন, “যত দিন ওর কেমোথেরাপি চলেছে, যত দিন জার্ম সেল ক্যানসারের সঙ্গে ওকে লড়তে হয়েছে, তাতে আমার মনে হয়, আরও কয়েক মাস অন্তত ওর মাঠের বাইরে কাটানো উচিত ছিল। ভয় হচ্ছে, আবেগকেই কি বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলল যুবরাজ?” দিল্লির ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডক্টর পল বলছেন, “সব রুগীরাই এই প্রশ্ন করে। কেমোথেরাপির পর কত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক শারীরিক কাজকর্ম শুরু করতে পারব? আমি দেখেছি, এক-একজনের ক্ষেত্রে এক-এক রকম প্রতিক্রিয়া হয়। অনেকেই দ্রুত হাঁপিয়ে ওঠে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি চালু করার পর। প্রথমে বোঝে না। আমরা তাদের বলি, তখনই শারীরিক কাজকর্ম থামিয়ে দিতে।”
সমস্যা হল, যুবরাজের যদি সেই পরিস্থিতি হয়, আইসিসি কোনও পরিবর্ত দেবে না। যুবরাজ সমর্থকেরা অবশ্য জোর গলায় বলছেন, গড়পড়তা রুগীকে দিয়ে সিংহহৃদয় স্পোর্টসম্যানের মানসিকতা মাপতে যাওয়াটাই মারাত্মক ভুল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তিনি ঝলমল করবেন, এই ধারণা ঠিক প্রমাণিত হোক বা ভুল। শ্রীলঙ্কায় ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে অনুষ্ঠেয় টুর্নামেন্টের প্রথম বল পড়ার আগেই অংশগ্রহণকারী সব দলকে ছাপিয়ে যুবরাজ একক ভাবে সর্বোত্তম চৌম্বকক্ষেত্র!

টুইটারে যুবরাজ
• মনে হচ্ছে এই প্রথম ভারতের হয়ে খেলতে নামব
• আমার উপর আস্থা রাখার জন্য বোর্ড, নির্বাচকদের ধন্যবাদ।
• যখন ক্যানসার ধরা পড়েছিল, তখন মনে মনে জানতাম যে এক দিন ঠিক ফিরে আসব।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.