|
|
|
|
|
|
শুধু অবহেলা |
‘আলো’ আঁধারেই |
শান্তনু ঘোষ |
কয়েক কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হয়েছিল প্রাসাদোপম বাড়ি। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আলো’। কিন্তু সেই বাড়িতেই এখন সন্ধে হলেই নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার!
দীর্ঘদিনের অবহেলায় ‘আলো’ এখন প্রায় ভুতুড়ে বাড়ি। মার্বেলে মোড়া মেঝেতে ধুলোর স্তূপ। দেওয়ালে, সিলিংয়ে জমেছে কালো ঝুল। কোথাও বা মাকড়সার জাল। বন্ধ ঘরগুলোর তালায় মরচে ধরেছে। কোথাও আবার ভেঙে পড়েছে দামি কাচের জানালা।
সালকিয়ার নন্দীবাগান এলাকার ৩৭ ভৈরব দত্ত লেন। প্রাসাদোপম বাড়ির এ হেন বেহাল দশা চোখে পড়বে সামনে দাঁড়ালেই। লোহার ফটকের বাইরে থেকে থামে ঘেরা বিশাল সাদা বাড়িটিকে কারও ব্যক্তিগত বাড়ি কিংবা গেস্ট হাউস বলে ভুল হতেই পারে। কিন্তু দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আগাছার জঙ্গলে প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া ফলক নজরে পড়লেই সে ভুল ভাঙবে। আসলে বাড়িটি হল হাওড়া জেলায় দৃষ্টিহীন ও ক্ষীণদৃষ্টি ছাত্রীদের জন্য প্রথম সরকারি আবাসিক বিদ্যালয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৮-এর ২৯ অক্টোবর মহা সমারোহে উদ্বোধন হয়েছিল এই স্কুলবাড়ির। তৎকালীন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য, সিপিএম সাংসদ স্বদেশ চক্রবর্তী, হাওড়া পুরসভার মেয়র গোপাল মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে বিদ্যালয়টির উদ্বোধন করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে খবর, হাওড়ায় দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রীদের জন্য মাধ্যমিক স্তরের কোনও স্কুল ছিল না। একমাত্র উলুবেড়িয়ায় মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি স্কুল রয়েছে। ২০০৮ সালে তৎকালীন সাংসদ স্বদেশ চক্রবর্তীর উদ্যোগে তৈরি হয় ‘আলো’। স্বদেশবাবুর সাংসদ তহবিলের সঙ্গে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের যৌথ উদ্যোগে চার কোটি টাকা ব্যয়ে ১.৮ একর জমিতে তৈরি হয়েছিল স্কুলবাড়িটি। |
|
তবে স্কুলবাড়ির জমির মালিকানা ছিল হাওড়া পুরসভার। একদা ওই জমিটি ফুড কর্পোরেশনকে লিজ দেয় পুরসভা। কিন্তু এফসিআই-এর পরিত্যক্ত গুদামটি এক সময় অসামাজিক কাজের আখড়া হয়ে ওঠে। শেষে স্বদেশবাবুর চেষ্টায় ফের জমিটি পুরসভার হাতে চলে আসে। এর পরেই ২০০৬ সালে ওই জমিতে দৃষ্টিহীন ছাত্রীদের আবাসিক বিদ্যালয় তৈরির পরিকল্পনা করেন স্বদেশবাবু। ২০০৮-এ শিলান্যাসও হয়। নিজের সাংসদ তহবিল থেকে এক কোটি টাকা এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের দেয় অনুদানে শুরু হয় স্কুলবাড়ি গড়ার কাজ।
হাওড়া পুরসভা সূত্রে খবর, দু’শো আসনের এই আবাসিক বিদ্যালয় প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্বে ছিল হাওড়া উন্নয়ন সংস্থা (এইচআইটি)। দোতলা স্কুলবাড়ির পিছনেই রয়েছে তিন তলা হস্টেল। মাঝে একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে আবাসিক ছাত্রীদের নিরাপত্তায় নজরদারির পরিকল্পনা ছিল। এ ছাড়াও ঠিক হয়েছিল, ব্রেল পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের পাশাপাশি ছাত্রীদের জন্য কম্পিউটার, গানবাজনা শেখারও ব্যবস্থা করা হবে। বিদ্যালয়টি পরিচালনার জন্য রাজ্য জনশিক্ষা কারিগরি দফতরের হাতে তুলে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু সবই রয়ে গিয়েছে পরিকল্পনার স্তরে। উদ্বোধনের পরে ‘আলো’তে আর এক বারও আলো জ্বলেনি এমনটাই দাবি ওই স্কুলবাড়ি তৈরির দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারের নিযুক্ত পাহারাদারদের। বিদ্যালয়ের সামনে নিরাপত্তারক্ষীদের জন্য তৈরি ঘরেই থাকেন চার জন। তাঁদের এক জন, সঞ্জয় যাদব বলেন, “২০০৯ থেকে এখানে আছি। একটা স্কুল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উদ্বোধন হলেও তার পরে আর কিছুই হল না।”
এলাকার বাসিন্দা সুদীপ ঘোষ বলেন, “রাতে এখানে অসামাজিক কাজকর্ম হয়। পুরো জায়গাটা খোলা পড়ে রয়েছে। স্কুলবাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গায় এখন জঙ্গল। রাতে কারা ঢুকছে, কারা বেরোচ্ছে কেউ জানে না।” এক পুলিশকর্তা অবশ্য আশ্বাস দেন, প্রতি রাতেই ওই সব পরিত্যক্ত জায়গায় পুলিশি টহল চলে।
|
|
কেন এ ভাবে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রইল স্কুলবাড়িটি?
স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক অশোক ঘোষ বলেন, “পরিকল্পনা ছাড়াই ওখানে একটি স্কুলবাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলেন স্বদেশবাবু। কয়েক কোটি টাকা জলে গেল। কিন্তু কিছুই হল না। আমরা ওই জমিটি যথাযথ ব্যবহারের জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি।” জবাবে স্বদেশবাবু বলেন, “আমি ২০০৯ পর্যন্ত সাংসদ ছিলাম। তার পরে শুনেছিলাম রাজ্য সরকার একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল। সেখানে পুরসভার মেয়র এবং রাজ্য ও জেলা প্রশাসনের কর্তারাও ছিলেন। কেন কাজ এগোয়নি, তা তাঁরাই বলতে পারবেন।”
অশোকবাবু জানিয়েছেন, আলো’র ভবনের পাশেও বিশাল জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেই জমিতে একটি কারিগরি কলেজ গড়ে তোলার জন্য জনশিক্ষা কারিগরি ও গ্রন্থাগার দফতরের মন্ত্রী আবু করিমের কাছে আবেদন জানিয়েছি। পাশাপাশি ‘আলো’র ভবনটিকেও কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তাব দিয়েছি। মন্ত্রীও বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অশোকবাবু বলেন, “হাওড়া পুরসভার তরফে এখনও জনশিক্ষা কারিগরি দফতরের হাতে জমি হস্তান্তর করা হয়নি। মেয়রকেও বিষয়টি জানিয়েছি। আশা করি হাওড়া জেলায় এই কারিগরি বিদ্যালয় তৈরির জন্য তিনি সহযোগিতা করবেন।”
হাওড়া পুরসভার মেয়র, সিপিএমের মমতা জয়সোয়াল বলেন, “রাজ্য সরকারের জনশিক্ষা দফতরের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে যাতে সুষ্ঠু ভাবে স্কুল চালু করা যা। আশা করি খুব শীঘ্রই সদুত্তর পাওয়া যাবে।”
|
ছবি: রণজিৎ নন্দী |
|
|
|
|
|