বেচারা সুশীলকুমার শিন্দে! কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রী থাকার অন্তিম পর্বে গ্রিডের গোলমালে সমগ্র উত্তর ও পূর্ব ভারত অন্ধকারে আচ্ছন্ন হওয়ার দায় তাঁহার উপরেই পড়িয়াছিল। মন্ত্রক বদলাইয়া সবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর তাঁহার হস্তে ন্যস্ত হইয়াছে। অসমের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লইয়া রাজ্যসভায় তাঁহার বক্তব্যের সময় সাংসদ জয়া বচ্চনের মন্তব্যের উপর তাঁহার টিপ্পনী লইয়াও সাংসদরা তাঁহার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িলেন। দোষের মধ্যে শিন্দে প্রাক্তন চলচ্চিত্রাভিনেত্রী জয়া বচ্চনকে বলিয়াছিলেন বিষয়টি গুরুগম্ভীর, কোনও ফিল্মি চিত্রনাট্য নয়, তিনি মন দিয়া শুনিতে থাকুন। শিন্দের মন্তব্যে হাল্কা বিদ্রুপ ছিল, সন্দেহ নাই। কিন্তু সামান্য রসবোধ থাকিলেই এটুকু বিদ্রুপ হজম করিয়া লওয়া যাইত। দুর্ভাগ্যের বিষয়, অভিনেত্রী জয়া ভাদুড়ী দর্শকদের যে সূক্ষ্ম রসবোধ প্রায়শ উপহার দিতেন, সাংসদ জয়া বচ্চন তাহা প্রদর্শন করিতে পারে নাই। অভিনয় আর চিত্রনাট্য রচনা এক নহে।
জয়া বচ্চনকে দোষ দিয়া লাভ নাই। রসবোধ কাহারই বা আছে? রাজ্যসভার বিরোধী নেতা অরুণ জেটলির আছে কি? থাকিলে, এই প্রসঙ্গে এ ভাবে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তুলোধোনা করিতে পারিতেন না। সাংসদ হিসাবে জয়া বচ্চনের মর্যাদার কথা স্মরণ করাইয়া রাজ্যসভাকে একটি শোকসভায় পরিণত করিতেও উদ্যত হইতেন না। জেটলি স্বভাবতই বিরোধী নেতা হিসাবে সরকারপক্ষকে কোণঠাসা করার একটা রাজনৈতিক উপলক্ষ রূপে বিষয়টিকে ব্যবহার করেন। কিন্তু সব কিছুর মধ্যে রাজনৈতিক সুযোগ অন্বেষণের প্রয়োজন কী? ভারতীয় গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য, রসবোধবর্জিত এই জনপ্রতিনিধিরা গম্ভীর মুখে আইনসভায় প্রবেশ করেন, ততোধিক গম্ভীর মুখে দিনের শেষে বাহির হইয়া যান। ঠাট্টা-ইয়ার্কি, কৌতুক-মজা, হাস্যরস, তির্যক বক্রোক্তি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপএ সব তাঁহাদের কাছে মর্যাদাহানিকর। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নেতাদের বাদানুবাদ, পরস্পরকে আক্রমণ করিয়া তির্যক মন্তব্য, সওয়াল-জবাবের ধারা অতি প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ। ভারতীয় আইনসভাতেও এক কালে রসবোধ মিলিত। ইদানীং কার্যত বিরল। এখানে সামান্য তির্যক মন্তব্য কিংবা ব্যঙ্গই হয় ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ বলিয়া গণ্য হয় এবং ‘অসংসদীয়’ বিবেচনায় কার্যবিবরণী হইতে বাদ দেওয়া হয়, নতুবা বক্তাকে মন্তব্য প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়।
বস্তুত, ভারতীয় সংসদের ইতিহাসে স্বাভাবিক রসবোধের ক্রমাবনতি ঘটিয়াছে। এই রসবোধ, এই মনের প্রসার জওহরলাল নেহরুর আচরণে অনেক সময়েই দেখা যাইত, তাঁহার সমসাময়িকদেরও অনেকেরই তাহা ছিল। উত্তরসূরিদের মধ্যে বিশেষ দেখা যায় নাই। এখন তো স্কুলপাঠ্য ইতিহাসের কেতাব হইতে নেহরু-অম্বেডকরের ব্যঙ্গচিত্রগুলিও সরকারি সিদ্ধান্তে প্রত্যাহৃত হইতেছে, মুখ্যমন্ত্রীর কার্টুন আঁকিলে কার্টুনিস্টকে পুলিশ গ্রেফতার করিতেছে। ব্যতিক্রম এ কালেও সম্পূর্ণ উধাও হইয়া যায় নাই। অটলবিহারী বাজপেয়ী যত দিন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, রাজনীতির শুষ্ক মরুচারিতা যাঁহার সিক্ত রসবোধের বর্ষণ কাড়িয়া লইতে পারে নাই। কিন্তু তাঁহারা বিরল ব্যতিক্রমে পরিণত। হয়তো ইহা ভারতীয় গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য। |