হস্তীর মতোই, জাতীয় আয়কে নানা ভাবে দেখা যায়। স্বভাবতই, সরকার ইহার সুযোগ লইয়া থাকে। যে দিক হইতে দেখিলে জাতীয় আয় তথা আয়বৃদ্ধির রূপটি ভাল দেখায়, সরকারি প্রবক্তারা তাহার উপর জোর দিয়া বলেন, ‘মা ভৈঃ’। সরকারের বিরোধী ও সমালোচকরাও তাঁহাদের সুবিধা অনুযায়ী দিক বাছিয়া লন। সত্যের নানা মূর্তি প্রদর্শিত হইতে থাকে, যেমন ‘রশোমন’ ছবিতে। কিন্তু হস্তীর স্বাস্থ্য যখন সম্পূর্ণ ভাঙিয়া পড়ে, তখন যে দিক হইতেই তাহাকে দর্শন করা হোক, তাহার দুর্দশা আড়াল করা যায় না। ভারতীয় অর্থনীতির এখন তেমনই দশা। জাতীয় আয়কে যে দিক হইতে, যে ভাবেই দেখা হোক, তাহার গতি অতি শ্লথ, এমনকী অনেক ক্ষেত্রে অধোমুখী। প্রণব মুখোপাধ্যায় এখনও নর্থ ব্লকে অধিষ্ঠিত থাকিলে হয়তো হস্তিদর্শনের দুরূহ একটি কোণ খুঁজিয়া বাহির করিতেন এবং বলিতেন, ‘চিন্তার কিছু নাই’। নূতন অর্থমন্ত্রী চিদম্বরম সেই চেষ্টা করেন নাই, জুন মাসে শিল্প-উৎপাদনের সদ্য-প্রকাশিত পরিসংখ্যান দেখিয়া তিনি সাফ সাফ মন্তব্য করিয়াছেন: হতাশাব্যঞ্জক।
শিল্প-উৎপাদন গত জুনের তুলনায় প্রায় দুই শতাংশ কমিয়াছে। মন্দার বাজারেও ইহা অপ্রত্যাশিত ছিল। শিল্প হইতে জাতীয় উৎপাদনের সিকিভাগও আসে না, সুতরাং ইহা অবশ্যই খণ্ডচিত্র। কিন্তু অল্পবৃষ্টি এবং অনাবৃষ্টির কারণে চলতি বছরে কৃষি-উৎপাদনের গতিও ব্যাহত হইবে, তাহা এখন প্রায় নিশ্চিত। ইহার পরেও বাকি থাকে পরিষেবা, জাতীয় আয়ে যাহার অবদান প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। কিন্তু সেই মহলেও বাতাস ক্রমশ শীতল হইতেছে, অতি সম্প্রতি অন্যতম প্রধান মোবাইল টেলিফোন কোম্পানির ত্রৈমাসিক হিসাবের (এপ্রিল-জুন) রিপোর্টে প্রকাশিত বিপুল লোকসানের সংবাদ তাহার প্রতীকমাত্র। ২০১২-১৩ সালে আয়বৃদ্ধি কেমন হইবে, সেই বিষয়ে নৈরাশ্য উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। বাজেটে অনুমিত ৭.৬ শতাংশ হইতে প্রত্যাশিত আয়বৃদ্ধি এখন ৬ শতাংশের নীচে নামিয়াছে, শেষ অবধি ৫ শতাংশও থাকিবে কি না বলা কঠিন।
জাতীয় আয়ের তিনটি প্রধান ভাগ: ভোগব্যয়, বিনিয়োগ এবং রফতানি। আপাতত তিনটিই বিপন্ন। রফতানি অনেক দিনই বিশ্ব অর্থনীতির মন্দায় আক্রান্ত। আয়বৃদ্ধি কমিলে এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হইলে ভোগব্যয়ে আঘাত অনিবার্য, ইতিমধ্যেই তাহার লক্ষণও স্পষ্ট। বাকি রহিল বিনিয়োগ। জুন মাসে মূলধনী পণ্যের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ কমিয়াছে, ছয় বছরে তীব্রতম অধঃপাত। মূলধনী পণ্যের উৎপাদন কমিবার অর্থ, বিনিয়োগে ভাটার টান। বিনিয়োগ-মন্দার মেঘ উত্তরোত্তর ঘনায়মান। তাহার প্রধান কারণ, অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে, সুতরাং বিনিয়োগ হইতে লাভ করিবার সম্ভাবনা সম্পর্কে শিল্পবাণিজ্যের পরিচালকদের সংশয়। দীর্ঘ দিন ধরিয়া আর্থিক সংস্কার স্থগিত হইয়া আছে, জমি বা পরিবেশের মতো বিবিধ প্রশ্নে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত শিকে হইতে নামানো যাইতেছে না। বেসরকারি উদ্যোগীরা বিভিন্ন ভাবে সরকারকে এই বদ্ধদশা বা নীতিপঙ্গুত্ব হইতে নিষ্ক্রমণের পরামর্শ দিয়াছেন। অর্থনীতিবিশারদরাও একই কথায় সমস্বর। কিন্তু সরকার নড়িতেছে না। চিদম্বরম প্রশাসন এবং নীতিকে নড়াইতে পারিবেন কি না, তাহা এখনও প্রশ্নমাত্র। ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রী পরিকাঠামো সংক্রান্ত বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্তাদের সহিত নিয়মিত বৈঠকের আয়োজন করিয়াছেন। কয়লা, বিদ্যুৎ, সড়ক ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ব্যাহত, সেই ব্যাঘাত দূর করিবার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিশ্চয়ই জরুরি। অর্থমন্ত্রীর তৎপরতা স্বাগত। কিন্তু তাহা যথেষ্ট নয়। রাজকোষ ঘাটতির অঙ্ক বাজেটের হিসাব ছাড়াইয়া বাড়িতেছে, জিডিপি’র অঙ্ক বাজেটের প্রত্যাশার ধারে কাছে পৌঁছাইতে পারিতেছে না। জাতীয় আয়ের অনুপাতে ঘাটতির মাত্রা দ্রুত বেলাগাম হইতেছে। এই ঘাটতি না কমাইলে অর্থনীতির সঙ্কট প্রবলতর হইবে। কিন্তু ঘাটতি কমাইবার জন্য সরকারের সাহস আবশ্যক। দিল্লির দরবারে সাহস দুর্লভ বস্তু। |