সিনেমা সমালোচনা...
তোমাকে অভিবাদন মুক্তধারা
ক মস্ত বড় গাঁট থেকে বাংলা সিনেমাকে যেন মুক্ত করল ‘মুক্তধারা’।
যে ধারায় চলছে সিনেমা তার এক ঘরানায় এইসান বাণীব্রত ছবি যে মেসেজের ঠেলায় সব বিনোদন চৌপাট হয়ে যায়। পাল্টা ঘরে বিনোদনের এমন হুল্লোড় যে ছবির মানে-মাথা খোঁজা বৃথা। ভাবা যায়, এমন একটা ছবি বাংলার পরিচালক জুটি শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আর নন্দিতা রায় করলেন যেখানে রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ গীতিনাট্যের সঙ্গে প্রায় পরতে পরতে মিলিয়ে দিলেন কলকাতার একটি জেলের কিছু কয়েদির জীবনের সেরা মুহূর্ত, ওঠা ও পড়া! জেল থেকে পালানোর চেষ্টা নিয়ে বেশ কিছু অপূর্ব ছবি হয়েছে অ্যাদ্দিনে। আমি শুধু তিনটের কথা বলব—‘ওয়ান ফ্লু ওভার দ্য কুকুস নেস্ট’, ‘এসকেপ টু ভিকট্রি’ এবং ‘পাপিয়োঁ’। মুক্তির খোঁজে পাগল এই তিন ছবির বন্দি চরিত্রদের সাফল্য কামনায় আমরা শ্বাস আগলে বসে থাকি। ‘মুক্তধারা’য় আমরা শেষ মুহূর্তগুলোয় সাফল্য চাই পুলিশের আই জি ব্রিজনারায়ণ দত্ত ও বন্দিদের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র পরিচালিকা নীহারিকার। কারণ? জেলকে নিছক বন্দিশালা থেকে বদলে সংশোধনাগার করে এবং ডাকাত থেকে কবি হয়ে ওঠা বাল্মীকির জীবন অভিনয় করিয়ে যে খুন-ডাকাতির আসামিদের একটা নতুন দিশা দেখানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন ওঁরা! মেসেজের ভারে এমন প্রকল্পর দফারফা হয়ে যাওয়ার কথা। তা তো হয়ইনি। বরং থ্রিলার হিসাবে গড়া কাহিনিতে শেষ রিল অবধি বাঁধা সাসপেন্স, সংলাপে-সংলাপে ধরানো ব্যক্তিত্ব সংঘাত ও হিউমার, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য সুরকে আবহ ও গানে প্রক্ষেপ করে পুরো ছবিটাকেই যেন একটা নৃত্যনাট্য হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। একটা পরিপূর্ণ প্যাকেজ।
‘মুক্তধারা’ এতটাই জীবনঘেঁষা যে এর জীবন বাদ দিয়ে সিনেমার কথা শুরুও করা যায় না। কয়েদিদের নিয়ে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ করছেন নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায় বেশ কিছুদিন যাবৎ। আর একটি এনজিও ফান্দা মনে করে দূরে দূরেই থাকছিলাম, তার পর হঠাৎ একদিন টিভিতে সে প্রযোজনা দেখে আমি তো থ। জীবনেও আমি এত ভাল বাল্মীকি প্রতিভা মঞ্চস্থ হতে দেখিনি! কিন্তু এহ বাহ্য। সে নাটক কয়েদিদের দিয়ে করতে অলকানন্দা যে জীবন ও অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন, তার টুকরো টাকরা খবর পেতে পেতে আমার কেনই জানি না আরেকটি বিশ্রুত ফিল্মের কথা মনে পড়ছিল, যেখানে এক খুনের আসামির মন বোঝার চেষ্টায় থাকা এক মহিলার জীবন বৃত্তান্ত আছে—‘লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং’। ছবিটা প্রেমের গল্প নয়, অথচ প্রেমেরই গল্প। অলকানন্দার ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ ও ওঁর প্রয়াস নিয়ে শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ‘মুক্তধারা’কেও একটা প্রেমকাহিনিই বলব। এবং সেই অলকানন্দার আদলে তৈরি নীহারিকার চরিত্রে ঋতুপর্ণার অভিনয়কে প্রেমেরই নিবেদন বলে মানব।
‘মুক্তধারা’র কেন্দ্রীয় চরিত্র নীহারিকা নৃত্যাঙ্গণা। তবে সংসারের বৃত্তে এক হাঁফিয়ে ওঠা কয়েদি। সে মূক-বধির কন্যা স্পৃহার মুখে কথা শুনতে পায় না। তার নির্মম চরিত্রের উকিল স্বামীকে মনের কথা বলার সুযোগ পায় না। হঠাৎ করে সুযোগ এল পুলিশ কর্তা ব্রিজনারায়ণ দত্তের এক অভিনব প্রকল্পে যুক্ত হওয়ায়। কয়েদিদের নিয়ে নাচের ওয়ার্কশপ। এরকম কাজে, বলা বাহুল্য শুরুটাই সমস্যা, শেষ দূরস্থান। অথচ এইখানেই আবির্ভাব ছবির নায়ক, প্রকৃত সমস্যা, অজস্র অপরাধে ফাঁসা ইউসুফ মহম্মদ খানের। সে আগেও জেল পালিয়েছে, নৃত্যনাট্যে নাম লেখানোর আগে চারটি শর্ত করেছে।
মুক্তধারা
ঋতুপর্ণা, নাইজেল, দেবশংকর, ব্রাত্য
তার মধ্যে দু’টোতাকে কলা ডিম মাংসের মেডিক্যাল ডায়েট আর সংশোধনাগারে পাহারাহীন ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা দিতে হবে। তবে ওর মূল অভিসন্ধি এই প্রযোজনার খোলামেলা সময়ের সুযোগ নিয়ে পালাবার পথ করা। আর হায় কপাল, ওর ঋদ্ধ পৌরুষ, চোখের ভাষা, চলাফেরা, কোমল ও কঠিনে মেশা চরিত্রের মধ্যেই নীহারিকা দর্শন করল ওর বাল্মীকিকে।
ফলত কাহিনি যত গড়াল তার কেন্দ্রে চলে এল ইউসুফ। সে চরিত্রে অভিনয় করা নাইজেল আকারাকে কিছুতেই আলাদা করা যায় না কী ইউসুফ কী বাল্মীকির থেকে। কারণ নাইজেলই সেই বন্দি যাকে বাল্মীকি করেছিলেন নীহারিকার মূর্ত চরিত্র অলকানন্দা। এই নাইজেলেরই বাল্মীকি টিভিতে দেখে প্রায় মূক-বধির হওয়ার দশা আমার! আর সেই নাইজেল ওরফে ইউসুফ ওরফে বাল্মীকি অবশেষে রুপোলি পর্দায়। এ হেন ছবির পক্ষে রুপোলি পর্দার বর্ণনাটা বোধ হয় ঈষৎ মেকি। বলতে হয় ‘মুক্তধারা’ হল সিনেমায় ধরা জীবনের মধ্যে জীবন। নাইজেল বাস্তব জীবনে অলকানন্দাকে ডাকেন মা, সিনেমায় ইউসুফ ও নীহারিকার সম্পর্ক প্রেমের দিকে এগোয় এবং তা খুবই বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে।
শেষ অবধি প্রথা, প্রশাসন, চক্রান্ত ও ট্রেড ইউনিয়নের শতেক গেরো পেরিয়ে কিন্তু ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ মঞ্চস্থ হয়। ‘এসকেপ টু ভিকট্রি’-তে বন্দিরা ফুটবলের লড়াই জিততে জিততে পালিয়েছিল সুড়ঙ্গ বেয়ে। ‘মুক্তধারা’র পোক্ত চিত্রনাট্যে তেমন নিষ্ক্রমণের প্রস্তুতি আছে। তবে শেষ অবধি মুক্তি? সংশোধনাগার থেকে শারীরিক মুক্তি বেছে নেওয়া, না-নেওয়া নির্বাচনই কাহিনি ও জীবনের বিষয় হয়ে ওঠে। বালিকার প্রাণ নেবে কি না দস্যু রত্নাকর আর জেল পালাবে কি না ইউসুফ এই দ্বন্দ্বই এক বিন্দুতে দাঁড় করায় বাল্মীকি ওরফে ইউসুফ ওরফে হয়তো নাইজেলকেও। সিনেমা ও জীবন এতটাই একাকার হয়ে যায়।
‘মুক্তধারা’র মেকিং-য়ে ত্রুটি বার করা খুবই মুশকিল। এত আঁটসাঁট চিত্রনাট্য যা গ্যাংস্টার মুভি এবং অপেরার ধরনধারণ, শৈলীকে বেঁধেছে। ছোটোখাটো চরিত্রেরও বিবর্তন দেখিয়েছে, দৃশ্যের গ্রন্থনা, কাহিনির গতি ও পরিণতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এবং গল্পের সঙ্গে সঙ্গে অপূর্ব একজোড়া নায়ক-নায়িকাকে পর্দায় ভাসিয়েছে। ঋতুপর্ণার নীহারিকা বহু দিন পর বাংলা ছবিতে এক ভিন্ন জাতের নায়িকা, যার মধ্যে প্রেম ও প্যাশন মিশেছে, ঠোঁটে গানও আছে আর তার পরেও অবিশ্বাস্য রকম বাস্তব। আর নাইজেলের ইউসুফ? মিঠুনের আবির্ভাবী অভিনয়ের ‘মৃগয়া’য় (হিন্দিতে হলেও নানা কারণে একে আমি বাংলা ছবিই বিবেচনা করি) যে কাজ চোখে পড়েছে, ‘মুক্তধারা’য় নাইজেলের পার্টকে আমি তার পাশাপাশি রাখব। চেহারা, চাহনি, সংলাপ বলা ও উপস্থিতিতে ওই তিনজনের পর এই এক আবিষ্কার। কাজের সুযোগ ও সমর্থন পেলে বাংলার আগামী সুপারহিরো (সুপারস্টার বলছি না কারণ তার অনেকটাই কপালের ব্যাপার)।
এ হেন চিত্রনাট্যকে যে লয়কারি ও ছন্দে এবং দৃশ্যের বিস্তারে ক্যামেরায় তোলা যায় সেটাই দিব্যি করে দেখিয়েছেন সিনেমাটোগ্রাফার অনিল সিংহ। যে কাজকে নিপুণ নিটোল করেছে মলয় লাহার সম্পাদনা। আর সঙ্গীত? সঙ্গীতই তো একটা চরম ভাষা এ ছবিতে। সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও জয় সরকারের সুরারোপ গান ও আবহের প্রয়োগে ছবিকে প্রায় অপেরাটিক করে তুলেছে। একটা প্রধানত কষ্টের ছবিকে সহনীয়, এমনকী আরামপ্রদ করেছে।
তবে সব দুঃখ কষ্ট আশা-আকাঙ্ক্ষা, জয়-পরাজয়, ফলিয়ে তোলে যে অভিনেতৃ গোষ্ঠী (নায়ক নায়িকা বাদে বলছি) তারা কেউই সে অর্থে পার্শ্বভূমিকায় নন। দেবশংকর হালদারের মর্মস্পর্শী পুলিশকর্তা ব্রিজনারায়ণ দত্ত তো বকলমে নায়কও। আর যত ভিলেনিই করুক নীহারিকার উকিল বর অরিন্দমই নাটকের চাকাটা প্রথম ঘোরাতে শুরু করে। এই নিয়ে মঞ্চে ও টিভিতে ব্রাত্য বসুর বেশ কিছু খলনায়ক দেখেছি। আচার আচরণ হিংস্রতায় তাদের থেকে খুব যে আলাদা অরিন্দম তা নয়। কিন্তু অভিনয়গুণে এতই বিশ্বাসযোগ্য যে মনে হয় ইউসুফ ও নীহারিকার মতো এও বুঝি জীবন থেকে পাওয়া। পুলিশের ট্রেড ইউনিয়নের নেতা হিসেবে খরাজ মুখোপাধ্যায় সুন্দর একটা ভূমিকায় এলেন। বদমাইশি, প্যাঁচপয়জারি টনটনে হিউমার মিশিয়ে যারা একেকটি প্রত্নদ্রব্যই যেন সারাক্ষণ পাবলিকের জীবন হাল্লাক করে দিয়েছে। দেবশংকরের ব্রিজনারায়ণ ও খরাজের চরিত্রটির উতোরচাপান বেশ কিছু সিকোয়েন্সকে রস জুগিয়েছে। শিবপ্রসাদ মুখেোপাধ্যায়ের মারকাটারি হ্যাপি সিংহ আর কিশোরী সুচিত্রা চক্রবর্তীর স্পৃহারও অভিনয় সুন্দর।
শেষে ফের একবার বলব অলকানন্দার কথা। নৃত্য পরিকল্পনা ওঁরই। কিন্তু নিজের যে জীবনটা অত পরিকল্পনা করে নয়, প্যাশন থেকেই ফলে উঠেছে সে জীবনই যেন আক্রান্ত করছে দর্শককে। ওকে শুধু বলার—তোমাকে অভিবাদন, নীহারিকা কারণ উনি তো...না থাক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.