|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
পরিচয় পাওয়া যায় নতুন আঙ্গিক ও ভাবনার |
সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল ‘অ্যান্টিভাইরাস’-এর সম্মেলক প্রদর্শনী। ঘুরে এলেন মৃণাল ঘোষ। |
দলের নাম ‘অ্যান্টিভাইরাস’। পাঁচ জন শিল্পী অন্তর্ভুক্ত। তাঁদের এক জন ভাস্কর। নাম থেকে ধারণা করা যেতে পারে সমাজসচেতন প্রতিবাদী চেতনা তাঁদের কাজের ভিত্তি। এই দলের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে। এ বারের প্রদর্শনীর একটি শিরোনামও তাঁরা নির্ধারণ করেছেন ‘ইন সার্চ অব অ্যান ইনার ওয়র্ল্ড’। শুধু বিষয় বা ভাবনাতে নয়, আঙ্গিকেও নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিচয় আছে কোনও কোনও কাজে। সব কাজ হয়তো সমান উত্তীর্ণ নয়, তবু কালচেতনা, নান্দনিক দায়বোধ ও মননের তন্নিষ্ঠতা প্রদর্শনীটিকে অভিনিবেশযোগ্য করেছে।
দীপঙ্কর দত্ত ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে ভাস্কর্যের স্নাতক। এখন সেখানেই শিক্ষক। এই প্রদর্শনীতে তাঁর ছ’টি নানা মাধ্যমের সমন্বয়ে করা ভাস্কর্য ইনস্টলেশনধর্মী। সাধারণ শিরোনাম ‘ফ্রেম’। কাঠের একটি আয়তাকার ফ্রেম রয়েছে সব কাজেই। সেটা প্রতীকী। জীবনের কাঠামো। তার এক প্রান্তে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার ইঙ্গিত। অন্য প্রান্তে মানুষের সভ্যতা প্রকৃতিকে যে ভাবে ধ্বংস করছে এবং এর ফলে জীবনে যে বিপর্যয় নেমে আসছে, তার আভাস। একটি রচনায় দেখতে পাই ফ্রেমের উপরে পাখি বসে আছে। নীচে আয়তাকার সমতল দু’ভাগে বিভাজিত। এক পাশে কণ্টকাকীর্ণ সবুজ। অন্য প্রান্তে নিবিড় অন্ধকার। সেই কাঁটায়, সেই অন্ধকারে ভূলুন্ঠিত বিশ্লিষ্ট, বিপর্যস্ত মানুষ। একক রূপের সংহতি থেকে ভাবনার বিস্তারে আসতে চেয়েছেন শিল্পী ত্রিমাত্রিক রূপায়ণে।
|
|
শিল্পী: সুজাতা পণ্ডিত |
স্বপনকুমার মল্লিকের সুররিয়ালিস্টধর্মী ছবিতে মানুষের যৌনতা এবং বৌদ্ধিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটের মধ্যে এক প্রবল সংঘাত চলতে থাকে। আধুনিক সভ্যতা ও আজকের বিশ্বায়ন মানুষকে যে ধ্বংসের প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে, তার বিরুদ্ধেই প্রতীকী ধারাভাষ্য গড়ে তুলতে চান তিনি। সবচেয়ে সংহত রূপকল্প গড়ে উঠেছে ‘আই ফ্রাইট’ শিরোনামে সিন্থেটিক টেম্পারার অপেক্ষাকৃত ছোট ছবিটিতে। বুনুয়েল-এর একটি ফিল্মের প্রেরণায় এঁকেছেন। একটি চোখ। ধারালো অস্ত্র ছেদন করছে তাকে। বিপর্যয়ের ভয়ঙ্কর প্রতীক। কন্টি, ড্রাই প্যাস্টেল ও কালিতে করা বড় ছবিগুলির কোনও কোনওটিতে একটু অতিকথনের প্রবণতা রয়েছে।
অনিন্দ্য পণ্ডিতের মিশ্র মাধ্যমের ১২টি কাগজের ছবিতেও আজকের জীবনের এই অমানবিক অনুষঙ্গই উঠে এসেছে। অনিন্দ্য রবীন্দ্রভারতী থেকেই চিত্রকলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। ‘সেলিব্রেটিং বার্থডে’ শীর্ষক তাঁর রচনাগুলিতে প্রতিমাকল্প ও প্রতীকী ব্যঞ্জনা অপেক্ষাকৃত সহজ।
অভিব্যক্তিবাদী আঙ্গিকে মানব-অবয়বকে সামান্য ভেঙেছেন। আজকের জীবনযাপনে রয়েছে দু’টি স্তর। একটি আপাতমুখী, সম্ভ্রান্ত। সভ্যতার সমস্ত মধু তাঁদের অধিকারে। অন্যটিতে জড়িয়ে আছে দারিদ্র ও শিক্ষাহীনতার অন্ধকার। এই দ্বিতীয় স্তর কী ভাবে পালন করে তাঁদের জন্মদিন। সেই সমীক্ষা থেকে গড়ে উঠেছে তাঁর ছবিগুলি। অন্ধকার বা ছায়াময়তার আবরণ ছড়িয়ে আছে সব ছবিতেই। সেই তমসাকে শরীরে ধারণ করে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর দিয়ে কানে চাপা রয়েছে হেডফোন। বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি তাকেও আক্রান্ত করে। কিন্তু জীবনের সঙ্গে একে সে মেলাতে পারে না। এই দ্বৈত থেকে বিচ্ছিন্নতার জন্ম হয়। সেই বিচ্ছিন্নতাকেই নানা ভাবে প্রশ্ন করতে চেয়েছেন শিল্পী।
সুজাতা পণ্ডিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে রবীন্দ্রভারতীতে প্রশিক্ষিত। জলরঙে আঁকা তাঁর ‘রিমেমবারিং রেবেকা’ ও ‘ফ্রোজেন মেমোরিজ’ শীর্ষক বড় ছবিগুলিতে তিনি নারীর অবস্থান ও বিচ্ছিন্নতাকে চুলে ধরতে চেয়েছেন, অতিরিক্ত আখ্যানধর্মী এই রচনাগুলি অনেক ক্ষেত্রেই একটু সচিত্রকরণ-ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মিশ্র মাধ্যমে করা ‘ফ্রোজেন মোমেন্ট’ সিরিজের ছোট ছবিতে চিত্রকল্পের সংহতি তাঁকে প্রার্থিত সাফল্য এনে দিয়েছে। জীবনের ছোট ছোট অজানা রহস্যকে তিনি উন্মীলিত করেছেন। পরিহার করতে পেরেছেন অতিকথনের অপ্রয়োজনীয় ভার।
দিবাকর কর্মকারও স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত রবীন্দ্রভারতীতে প্রশিক্ষিত। অ্যাক্রিলিকে আঁকা চারটি বড় আকারের বিমূর্ত ক্যানভাসে তমসাকে আত্মস্থ করে আলোর অভীপ্সা ব্যক্ত করেছেন। আকাশ ও আলোয় বিস্তৃত হয়ে আছে যে অসীম, তারই অনুধ্যান তাঁর ছবিতে। মানবিক সংকট আচ্ছন্ন করে সেই উদাত্ততাকে। করুণ সুর জেগে ওঠে অস্তিত্ব জুড়ে। সেই করুণার ছায়া-প্রচ্ছায়াও খুব সন্তর্পণে আভাসিত হয়। এই প্রদর্শনীর সাধারণ শিরোনাম যে ‘অন্তর্জগতের সন্ধান’, তার আভাসকে শিল্পী পরিব্যাপ্ত করতে চেয়েছেন নৈসর্গিক বিমূর্তায়নের মধ্য দিয়ে। |
|
|
|
|
|