আনন্দমার্গীদের পুড়িয়ে মারা, হুল উৎসবে সাঁওতাল হত্যা, হিডকোয় দুর্নীতির অভিযোগ এই সব নিয়ে যাঁর আমলে রাজ্য-রাজনীতি তোলপাড় হয়েছিল, প্রয়াত সেই জ্যোতি বসুর সরকারি বসতবাড়ি, সল্টলেকের ইন্দিরা ভবনেই বসছে ঘটনাগুলির বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন!
পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সাড়ে তিন দশকব্যাপী বাম জমানায় চব্বিশ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। তাঁর এই দীর্ঘ শাসনকালে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঘটনায় রাজ্য বার বার উত্তাল হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কখনও তিনি তদন্ত করে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছেন। কখনও আবার চরম উদাসীনও থেকেছেন বলে বিরোধীদের অভিযোগ।
এবং গত বছর রাজ্যে সরকার বদলের পরে নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত বাম জমানার গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত যে দশটি ঘটনা নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন, তার চারটি জ্যোতিবাবুরই আমলের। এর একটা হল ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই কলকাতায় যুব কংগ্রেসের ‘মহাকরণ অভিযান’ প্রতিরোধে পুলিশের গুলিচালনা। যার তদন্তে প্রাক্তন বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন কমিশনের কাজ চলছে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে, রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের পুরনো অফিসে। আর বাকি তিনটি, অর্থাৎ আনন্দমার্গী নিধন, হুল-হত্যা ও হিডকোয় দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অফিস ইন্দিরা ভবনে হবে বলে সরকারি সূত্রের খবর। এ হেন সিদ্ধান্ত কেন?
সরকারের এক মুখপাত্রের ব্যাখ্যা, বিচার বিভাগীয় কমিশনের অফিস করার উপযুক্ত জায়গার অভাব রয়েছে। তাই নগরোন্নয়ন দফতরের হাতে থাকা সল্টলেকের ওই বাড়িটাকে বেছে নেওয়া হল। ১৯৭৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে জ্যোতিবাবু তাঁর হিন্দুস্থান পার্কের বাড়ি থেকেই মহাকরণে যাতায়াত করতেন। ১৯৮৯-এ তিনি ইন্দিরা ভবনে গিয়ে ওঠেন। মৃত্যুর আগে হাসপাতালে যাওয়া পর্যন্ত ওটাই ছিল তাঁর সরকারি ঠিকানা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে ইন্দিরা ভবনের নাম বদলে ‘নজরুল অ্যাকাডেমি’ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, যা নিয়ে বামফ্রন্টের দিক থেকে তো বটেই, রাজ্য সরকারের শরিক কংগ্রেসের তরফেও প্রবল আপত্তি ওঠে। ইন্দিরা ভবনের গেটে প্রতিবাদ-বিক্ষোভও হয়। পরে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করে নেন।
১৯৮২-র ৩০ এপ্রিল দক্ষিণ কলকাতার বিজন সেতুতে আনন্দমার্গীদের পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এর তদন্তভার দেওয়া হয়েছে প্রাক্তন বিচারপতি সন্তোষকুমার ফৌজদারকে। ১৯৯৯-এর ৩০ জুন তদানীন্তন অবিভক্ত মেদিনীপুরে হুল উৎসবের দিনে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাঁওতাল হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। তার তদন্তের দায়িত্বে আছেন প্রাক্তন বিচারপতি এন এন ভট্টাচার্য। আবার দেড় দশকেরও বেশি আগে রাজারহাটে হিডকো-র জন্মলগ্ন থেকে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও জমি-ফ্ল্যাট বণ্টনে নিয়মভঙ্গের অভিযোগের তদন্তভার বর্তেছে প্রাক্তন বিচারপতি রণেন্দ্রনারায়ণ রায়ের উপরে। এই তিনটি ঘটনার সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। অন্য দিকে প্রয়াত আর এক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে কাশীপুর-বরাহনগর গণহত্যার তদন্তে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিশনের অফিসও হচ্ছে ইন্দিরা ভবনে। ১৯৭১-এর ১২ অগস্টের ওই ঘটনার তদন্তের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রাক্তন বিচারপতি এ কে বিশি।
এ পর্যন্ত মমতা সরকারের গড়া মোট দশটি ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের মধ্যে সিপিএম বিধায়ক মোস্তাফা বিন কাশেমের মৃত্যুর তদন্ত-রিপোর্ট ইতিমধ্যে জমা পড়েছে। রিপোর্ট মোতাবেক, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। চারটি কমিশনের কাজ চলছে শিল্পোন্নয়ন নিগমের অফিসে। আমরি’র অগ্নিকাণ্ড নিয়ে কমিশন বসেছে তন্তুজ ভবনে। এ বার ইন্দিরা ভবনে অফিস খুলে কাজ শুরু করবে বাকি চারটি। |