মেরি ফোন করলে টিভি খুলবে পরিবার
পাহাড়ের ধাপে চাষবাস সেরে ঘেমো গায়ে ঘরে ফিরলেন টংপা। মেদহীন, পেটানো শরীরটা দেখলেই বোঝা যায়, মেয়ের গায়ের জোরের উৎসটা কোথায়। মেজো মেয়ে অ্যান ঝটপট বাবার গায়ে জামা পরিয়ে দিলেন। হেসে বললেন, “কত বার বলেছি, বাইরের লোক ক্যামেরা নিয়ে আসছে আজকাল! একটু ভদ্র পোশাকে থেকো। কে শোনে কার কথা?”
স্থানীয় কুকি ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা বোঝেন না টংপা, অলিম্পিক পদক জয়ী বক্সার মেরি কমের বাবা। অ্যানই দোভাষীর ভূমিকা নিলেন। কিন্তু শুরুতেই ঝটকা! মেরির পরের খেলা কবে? টংপা-অ্যান মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। আগামী কালই যে সেই খেলাটা, যার জন্য অপেক্ষা করছে গোটা দেশ, সেটাই জানেন না বাবা-বোন-ভাইয়েরা! “সত্যিই জানি না।” অ্যান বলেন, “দিদি যে দিন ফোন করে বলে, খেলা আছে, গোটা গ্রামকে খবর দিই। আজ এখনও তো ফোন করেনি।”
ইম্ফল থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে চূড়াচাঁদপুরের কাংথেই কম গ্রাম। প্রত্যন্ত বললেও কম বলা হয়। গোটা গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ১৩০! এইখানেই ঘাপটি মেরে রয়েছে মাংতে চুংনেইজাং মেরি কমের শৈশব। বাবা মাংগতে টংপা কম আর মা সান্নেইখাম পেট চালান ঝুম চাষ করে। ধান, মরসুমি সব্জি। মেরির পরে আরও দুই বোন, এক ভাই। ছোট বোন সবে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। বোন, ভাইকে দেখার ভার মেরির উপরেই ছিল। সেই সঙ্গে চাষের কাজে বাবা-মাকে সাহায্যও করতে হত। তার মধ্যেই চলছিল দৌড়নো, লাফানো, খেলাধুলো। মণিপুরিদের স্থানীয় কুস্তি ‘মুংনা’য় ওস্তাদ ছিলেন মেরির বাবা। কুংফুর চর্চাও একটুআধটু করেছেন। মেয়ে যতক্ষণ ভাইবোনের সঙ্গে খেলতে খেলতে লতা মঙ্গেশকরের গান গুনগুন করত, বাবা-মা তত ক্ষণই নিশ্চিন্ত! মেয়ে যখন, গান-টান করবে। ঘরের কাজকম্ম শিখবে। তার পর বিয়ে।
খুদে বক্সার। মেরির দুই ছেলে। —নিজস্ব চিত্র
কিন্তু মেরির মধ্যে কেমন যেন ‘ছেলে ছেলে’ ভাব! স্কুলে ছেলেরা ব্যঙ্গ করে। প্রায়ই মারপিট। টংপা বলছিলেন, “মেরির তখন বছর দশেক বয়স। ফসল বেচা টাকায় বউ-মেয়েদের সোনার গয়না দেব বললাম। মেরি জেদ ধরল ছেলেদের মতো জিন্স চাই।” ভাই খুপরেং বলছিল, “ক্লাসের কেউ আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করলেই নালিশের জায়গা ছিল দিদি। সোজা গিয়ে ঘুসি, চড় মেরে সিধে করে দিয়ে আসত ‘অবাধ্য’ ছেলেদের।”
মইরাং-এ লোকটাক খ্রিস্টান মিশন স্কুলে পড়ার সময়ই খেলার প্রতি ঝোঁকটা আরও বাড়ে মেরির। এর পর সেন্ট জেভিয়ার্সে গিয়ে দৌড়ে রীতিমতো নাম করে সে। সবাই যখন ভাবছে, মেয়েটা দারুণ অ্যাথলিট হবে। তখনই মণিপুরের ডিঙ্গো সিংহ এশিয়াডে বক্সিং সোনা পেলেন। মেরির মাথাতেও বক্সিং-এর ভূত চাপল। ইম্ফলের আদিমজাতি স্কুলে ভর্তি হয়েই বক্সিং নিয়ে খবরাখবর নিতে শুরু করল মেরি। মা-বাবার মাথায় হাত। কিন্তু মেরি অনড়।
ভাই খুপরেং বলছিল, “বকা খেয়ে বাবাকে না বলেই বক্সিং চালিয়ে যাচ্ছিল দিদি। রাজ্য পর্যায়ে প্রথম হওয়ার পরে কাগজে ছবি বেরল। বাবাও জানলেন।” টংপা দাওয়ায় বসে হাসতে হাসতে বলেন, “আমি আর ওর মা কত সাবধান করলাম! ঘুসোঘুঁসি করলে মুখের চেহারাই তুবড়ে যাবে। পাত্র মিলবে না। কিন্তু মেয়ে বলে দিল, বক্সিংই ওর প্রথম প্রেম।” আর মানা করেননি টংপা। বরং জমি-বাড়ি-আসবাব, একের পর এক সম্পত্তি বিক্রি করে মেয়ের সাধ পূরণের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।
সাইয়ের শিবিরে প্রশিক্ষণের সময় মেরির সম্ভাবনা চিনতে ভুল করেননি দুই ‘ক্ষিদ্দা’, কোচ কিষেণ ও ইবোমচা সিংহ। তার পর রাজ্যের দুই কোচ নরজিং সিংহ ও কিষেণ সিংহ মেরির ভার নেন। মণিপুর বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের সচিব তথা ভারতীয় বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের উপসভাপতি খোইবি সালামেরও নজর পড়ল মেরির উপরে। এত দিনে নিশ্চিন্তে প্রশিক্ষণ শুরু করল দরিদ্র মেয়েটি।
ফলও মিলল। ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গে সপ্তম পূর্ব ওপেন বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা। পরের বছর চেন্নাইয়ে প্রথম জাতীয় মহিলা বক্সিং ও দিল্লির সিনিয়র মহিলা বক্সিং-এ জোড়া সোনা। ২০০১ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক মহিলা বক্সিং-এর ফাইনালে হেরে রুপো। ২০০২ সালে ফের ন্যাশনাল গেমস ও জাতীয় মহিলা ক্রীড়ায় জোড়া সোনা। দ্বিতীয় বিশ্ব মহিলা বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা। এর পর ২০০৩-৫, ২০০৮ ও ২০১০ সালে পরপর জাতীয় মহিলা বক্সিং-এ মেরির গলায় স্বর্ণপদক। ২০০২, ২০০৫-৬, ২০০৮ ও ২০১০ পাঁচ বার মহিলা বক্সিং-এ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
এর মধ্যেই পুলিশের সাবইনস্পেক্টর থেকে ডিএসপি হয়েছেন ৫ ফুট ২ ইঞ্চির মেরি। ইম্ফলের লাঙ্গোল গেমস ভিলেজে মিলেছে বাড়ি। বন্ধু ও পদপ্রদর্শক কে ওনলার কমকে ২০০৫ সালে বিয়ে করেছেন। যমজ পুত্রের মা হয়েছেন। ২০০৬ সাল থেকে নিজের সরকারি আবাসের ভিতরেই বক্সিং আকাদেমি শুরু করেছেন। বর্তমানে সেই আকাদেমিতে ১৬ জন মেয়ে ও ২১ জন ছেলে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ২৭ জন অ্যাকাডেমিতেই থাকে। নিজের ছেলেরাও বাদ যায়নি। সেমিফাইনালের আগের দিন সন্ধ্যায় গেমস ভিলেজের নিস্তরঙ্গ বাড়িটাকে দেখে মনে হবে না, এরই মালকিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোটা দেশ। স্বামী ওনলার সঙ্গে গিয়েছেন মেরির। গিয়েছেন মেরির মা-ও। লন্ডন যাওয়ার আগে এক স্পনসর দুই সঙ্গীর খরচ দেবে বলেছিল। অ্যান বলে, “বাবা চাষবাষ ছেড়ে লন্ডন-টন্ডন যেতে রাজি হননি। তাই জামাইবাবুর সঙ্গে মাকেই পাঠানো হল।” বাড়ির সামনে বাঁধা জার্মান শেফার্ড ব্রুনো। আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেরির বাকি পোষ্যরাও। স্কুবি, ডলি, স্টেফি। অ্যাকাডেমিতে গরমের ছুটি। তবে ছাত্রছাত্রীদের কয়েক জন থেকে গিয়েছে। মেরির দুই ছেলে রেচুংভার ও খুপনেইভার বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিল। ফিরে এসেই বক্সিং গ্লাভ্স হাতে গলিয়ে দু’জনের বেদম লড়াই। কোনও মতে তাদের আলাদা করা হল। বাড়ির দায়িত্ব আপাতত সামলাচ্ছেন মেরির সঙ্গী ও সচিব জিমি লেইভন। বাচ্চাদের দেখছেন নিকোলাস, নেনিং, টোনি, খাম্পি, গ্লোরিয়ারা। কেউ আত্মীয়, কেউ ছাত্রী।
গ্লোরিয়া বলেন, “ফাইনালে জিতলে ঠিক কী ভাবে উৎসব করা যায় ভাবছি। বাজি কিনতে হবে। পার্টি হবে!” ফাইনালটা কবে? ফের ধাক্কা। শহরের বাড়ির লোকও জানেন না ফাইনাল কবে! কেউ বললেন ৯! কেউ বা ১০! নিকোলাস বললেন, “দূর, আমাদের সব কিছুতে মেরিই ভরসা। ও ঠিক সময় মতো জানিয়ে দেবে।”
মেরিকে ছোট্ট থেকে দেখেছেন যে পড়শিরা, তাঁদের বাড়ির মেয়েরা এখন দল বেঁধে মেরির বাড়ির টিভিতে খেলা দেখতে যান! পরিবার মেরির জন্য যা যা করেছিল, সুদে আসলে সবই ফিরিয়ে দিয়েছেন মেরি। গ্রামে একটামাত্র মাটির ঘরে সবাই মিলে থাকতেন। আজ সেখানে চারটি ঘর। বৈঠকখানায় রাখা দামি ল্যাপটপ, এলসিডি টিভি, সোফা। মেরির সংবর্ধনায় পাওয়া শালেই একটা আলমারি ভর্তি। ঘরের এক পাশেই বিরাট হাঁড়িতে রান্না বসানো। ঘর আরও বাড়ানো হচ্ছে। ইম্ফলে কেনা হয়েছে জমিও। অ্যান বললেন, “সবই দিদির দৌলতে। আস্তে আস্তে গোটা গ্রামটাই কেমন বিখ্যাত হয়ে উঠেছে দেখছেন?” সত্যি! এক অখ্যাত গ্রামের অনামী চাষির বাড়ির হদিস ইম্ফল থেকে বিষ্ণুপুর, লোকটাক থেকে চূড়াচাঁদপুরের সব পথচারী-দোকানদার দিয়ে দিচ্ছেন! সন্ত্রাসবিধ্বস্ত, দারিদ্রক্লিষ্ট রাজ্যটা এত দিন কেবল নেতিবাচক খবরের জন্যই শিরোনাম হতে জানত! সেই মণিপুরে আজ দিন বদলের ভরসা মেরি কম!

আজ
বক্সিং
মেরি কম বনাম নিকোলা অ্যাডামস (গ্রেট ব্রিটেন) (সন্ধ্যা ৬-১৫)
দেবেন্দ্র সিংহ (রাত ১-১৫)

ডিসকাস থ্রো
বিকাশ গৌড়া (রাত ১২-১৫)
৮০০ মিটার
টিন্টু লুকা (বিকেল ৪-০৫)
গত কাল
বক্সিং
বিজেন্দ্র সিংহের বিদায়
ট্রিপল জাম্প
রেঞ্জিথ মহেশ্বরী ফাইনালের যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ
হকি
বেলজিয়ামের কাছে হার ০-৩




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.