টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য দুই ছাত্রের
তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে কোলাহল।
স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তার পাশে গানটা কানে গিয়েছিল রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুলের ছাত্র ইকবাল শেখ ও সুইট শেখের। স্কুলে রবীন্দ্র প্রয়াণ দিবস পালন করে ফিরছিল তারা। আর তখনই চোখে পড়ে শহরের রবীন্দ্রভবনে বিকেল তিনটেতেও রবীন্দ্রনাথের মূর্তিতে কোনও মালা পড়েনি। কোনও অনুষ্ঠানও হয়নি। বাইরের দরজায় তালা।
ষষ্ঠ শ্রেণির দুই ছাত্র তখনই ঠিক করে, ওই মূর্তি এই দিন ওই ভাবে ফেলে রাখা যাবে না। তারাই মালা পরাবে। সেই মতো সামান্য যা কিছু টাকা ছিল তাদের কাছে, তাই দিয়ে মালা কিনেও ফেলে দু’জনে। কিন্তু তারপরে ভিতরে ঢুকবে কী করে? দরবেশপাড়ার ইকবাল আর সুজাপুরের সুইট তখন পাঁচিল টপকে রবীন্দ্রভবনে ঢুকে পড়ে। কিন্তু মূর্তি তো বেশ উঁচু। রবীন্দ্রনাথের গলা পর্যন্ত যে হাত পৌঁছচ্ছে না! সেই উপায়ও ঠিক হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। এক জনের ঘাড়ে উঠে মালা পরায় আর এক জন। তারপরে সে নেমে দাঁড়ায়। তার ঘাড়ে চেপে মালা পড়ায় অন্য জন। রঘুনাথগঞ্জের রবীন্দ্রভবনের রবীন্দ্রনাথের গলায় তাই শেষ পর্যন্ত ২২ শে শ্রাবণে দু’টি মালা দেখা গিয়েছে।
সুইট শেখের কথায়, “রবি ঠাকুরের লেখা জাতীয় সঙ্গীত জনগণমন রোজ গাই স্কুলে। কিন্তু তাঁরই মৃত্যুর দিনে তাঁর গলায় মালা নেই দেখে খুব কষ্ট হল। ভিতরে ঢুকে মূর্তির কাছে গিয়ে দেখি একরাশ ধুলো জমে রয়েছে। মূর্তির উপর হাত দিয়ে কোনরকমে ধুলো ঝেড়ে মালা পরিয়ে দিই।”
প্রয়াণ দিবসে কবি-প্রণাম। কৃষ্ণনগরে শতকণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আয়োজন।
ইকবালের বাবা রাজমিস্ত্রি। সুইটের বাবা দিনমজুর। তাদের কাণ্ড কিন্তু নজর এড়ায়নি পথ চলতি লোকজনের। কৌতুহলী মানুষের ভিড় থমকে যায় তালাবন্ধ রবীন্দ্রভবনের সামনে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রোবজুল হোসেন এই পথ ধরেই তখন আদালত থেকে ফিরছিলেন। সব দেখেশুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “দুই ছোট্ট স্কুল পড়ুয়ার মধ্যে যে সচেতনতা এসেছে, তা থেকে সকলের শিক্ষা নেওয়া উচিত।” কংগ্রেস কাউন্সিলর বিকাশ নন্দও ওই রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁর কথায়, “প্রথমে বুঝতে পারিনি কী ঘটছে। শুধু দেখলাম স্কুলের পোশাক পরা দুই ছাত্র কাঁধে স্কুল ব্যাগ নিয়ে রবীন্দ্রভবনের প্রাচীর টপকাচ্ছে। তাদের হাতে দুটো গাঁদা ফুলের মালা। বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর যা দেখলাম তাতে যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দুই ছাত্র পায়ের চটি খুলে একে অন্যের কাঁধে চড়ে উঁচু রবীন্দ্রমূর্তিতে মালা পরানোর চেষ্টা করছে। উঁচুতে থাকা মূর্তিতে হাতের নাগাল পাচ্ছে না। অনেক কসরতের পর সে মালা তারা পরাতে পেরেছে। মালা পরিয়েই দুজনে আবার প্রাচীর টপকেই নেমেছে রাস্তায়। ভাবলাম ওদের ডেকে মিষ্টি খাওয়াই। কিন্তু তত ক্ষণে ওরা সাইকেলে চেপে পিঠটান দিয়েছে বাড়ির দিকে।” বিকাশবাবুর ক্ষোভ, “পুরসভার কর্তাদের এর থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত লজ্জা পাওয়া।’’
রঘুনাথগঞ্জে রবীন্দ্রভবনে কবির মূর্তিতে মালা দিল দুই স্কুল পড়ুয়া।
জঙ্গিপুর পুরসভার পুরপ্রধান সিপিএমের মোজাহারুল ইসলাম যেন আকাশ থেকে পড়েন। হতবাক হয়ে তাঁরই প্রশ্ন, “আজ বাইশে শ্রাবণ? আমাদের তো মনেই ছিল না! ভুল হয়েছে, স্বীকার করছি। এ জন্য আমরা অনুতপ্তও।” সেই অনুতাপের তাড়নায় দিন ফুরিয়ে ঠিক সন্ধ্যা লাগার মুহূর্তেই এক পুরকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে বন্ধ রবীন্দ্রভবনে মালা পরিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে যান রবীন্দ্রমূর্তিকে। ওই পুরসভারই সিপিআই কাউন্সিলর তথা উপ পুরপ্রধান অশোক সাহার পাড়াতেই এই রবীন্দ্রভবন। অশোকবাবু বলেন, “এটা অমার্জনীয় ভুল, সেটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। গতবছর তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের সহায়তায় রবীন্দ্রভবনে অনুষ্ঠান হয়েছিল এই দিনে। এ বার সত্যিই এই দিনটার কথা স্মরণে ছিল না। ওই দুই ছাত্র রবীন্দ্রমূর্তিতে মালা পরিয়ে শিক্ষা দিয়ে গেল।”
জঙ্গিপুর মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক সুভাষ চৌবে এদিন ব্যস্ত ছিলেন সাগরদিঘির মোড়গ্রাম হাইস্কুলে ২২ শে শ্রাবণ স্মরণে এক সরকারি অনুষ্ঠানের আয়োজনে। তাঁর সাফাই, “আগে জানলে অবশ্যই পুরকর্তাদের ডেকে আমরা গিয়ে এই ভুল সংশোধন করে অন্তত মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসতে পারতাম। তবে যেহেতু রবীন্দ্রভবনটা জঙ্গিপুর পুরসভার নিয়ন্ত্রণে তাই এই ব্যাপারে দায়িত্বটা তাদেরই।” জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক করুণাময়ী ভৌমিক বলেন, “পুরসভার এমন ভুল হল কি করে? স্কুল ফের যে দু’জন ছাত্র প্রচীর টপকে গিয়ে রবীন্দ্রমূর্তিতে মালা পরিয়েছে কার্যত তারা বড় শিক্ষা দিয়ে গেল। রবীন্দ্রভাবনা তাদের মধ্যেও যে কতটা সঞ্চারিত করেছে এই ঘটনা তারই প্রতিফলন এরজন্য ওই দুই স্কুল ছাত্রকে পুরস্কৃত করা উচিত।”

—নিজস্ব চিত্র।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.