প্রণব মুখোপাধ্যায় গেলেন, পালানিয়াপ্পান চিদম্বরম আসিলেন। আপাতদৃষ্টিতে ইহাই নর্থ ব্লকের গল্প। কিন্তু, আপাতদৃষ্টিতেই। পালানিয়াপ্পান চিদম্বরম বেশ কয়েক বৎসর পরে অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব ফিরিয়া পাইয়াই ঘোষণা করিলেন, প্রণববাবু আয়কর আইনে যে জেনারেল অ্যান্টি-অ্যাভয়েড্যান্স রুল-এর ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, তাহা পুনর্বিবেচনার ব্যবস্থা হইতেছে। অস্যার্থ, অতীতমুখী এই আইনটি নিতান্ত অপ্রাপ্তবয়সেই গতায়ু হইল। ইহাকে নেহাতই একটি সিদ্ধান্ত হিসাবে দেখা চলে, আবার প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ব্যক্তিবিশেষের গুরুত্বের সূচক হিসাবেও দেখা সম্ভব। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তাঁহার প্রধানমন্ত্রী বা দলনেত্রীর সহিত পরামর্শ না করিয়া, অথবা তাঁহাদের মতামত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া এই আইনটি তৈরি করিয়াছিলেন, তেমন ভাবিয়া লওয়ার কোনও কারণ নাই। আবার, নূতন অর্থমন্ত্রীও তাঁহার নেতাদের সহিত আলোচনা না করিয়াই আইনটিকে হিমঘরে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিতেছেন, এই কথাটিও সমান অবিশ্বাস্য। কথাটি হইল, যখন প্রণব মুখোপাধ্যায় অর্থমন্ত্রী ছিলেন, অর্থ মন্ত্রকে তাঁহার চরিত্রের প্রতিফলন ঘটিত। এখন নূতন অর্থমন্ত্রীর চারিত্রিক প্রতিফলন ঘটিতেছে। চিদম্বরমের ইতিহাসও দাগমুক্ত নহে। তিনি যেমন ভারতে ‘সবুজ বাজেট’ পেশ করিয়াছিলেন, তেমনই ফ্রিঞ্জ বেনিফিট ট্যাক্স বা এ টি এম হইতে টাকা তোলার উপর করের ন্যায় অদ্ভুত ব্যবস্থাও তাঁহারই মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল। তবুও, প্রণব মুখোপাধ্যায় আর পালানিয়াপ্পান চিদম্বরম এক নহেন। সেই কারণেই, এই দুই সেনাপতির অধীনে নর্থ ব্লকও দুইটি ভিন্ন পথে চলে। ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রকের ন্যায় প্রতিষ্ঠানও যখন ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা এতখানি প্রভাবিত হয়, তখন কোথায় কাহার হাতে দায়িত্ব দেওয়া হইতেছে, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক হইতে হইবে বইকী। সুশীলকুমার শিন্দেদের সংখ্যা বাড়িলে তাহার ফল বিষম হওয়াই স্বাভাবিক।
পালানিয়াপ্পান চিদম্বরম যে সিদ্ধান্তটি করিলেন, তাহা এক প্রকার অনিবার্য হইয়া উঠিতেছিল। জেনারেল অ্যান্টি-অ্যাভয়েড্যান্স রুল চরিত্রে অতীতমুখী। অর্থাৎ, অতীতে আয়কর আইনের ফাঁকফোকর গলিয়া বিভিন্ন সংস্থা যে কর বাঁচাইয়াছে, এই ব্যবস্থা সেই কর আদায় করিবার জন্যই তৈরি। কেহ বলিতেই পারেন, ইহা উত্তম ব্যবস্থা যাহারা কর ফাঁকি দিয়াছে, তাহাদের টুঁটি চাপিয়া ধরাই তো সরকারের কাজ! কথাটি বিভিন্ন স্তরে ভুল। প্রথম ভুল, এই ব্যবস্থা একটি মারাত্মক বার্তা প্রেরণ করিতেছে ভারত সরকার বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করিতেছে না। এই বার্তাটির কতখানি ন্যায্য, আর কতটা অতিকথন, সেই তর্ক অর্থহীন ভারতে যে সময় বিদেশি বিনিয়োগের স্রোত ক্ষীণ হইতে ক্রমে ক্ষীণতর হইতেছে, সেই সময় এই বার্তা অর্থনীতির পক্ষে মারাত্মক হইতে পারে। গোটা দুনিয়াই বিনিয়োগকারীদের মনোভাবকে পরোয়া করে। ভারতের ব্যতিক্রম হইবার সাধ্যও নাই, কারণও নাই। কিন্তু, শুধুমাত্র বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তার কারণ হইয়াছে বলিয়াই এই নূতন আইনটি ভুল নহে, তাহার নৈতিক ভিত্তিটিই ভ্রান্ত। অতীতে যাহা ঘটিয়া গিয়াছে, আইন করিয়া তাহা সংশোধন করা চলে না। আইনের একটিই অভিমুখ, তাহা সর্বদাই ভবিষ্যগামী। আয়কর আইনে যাহাতে ছিদ্র না থাকে, কেহ যেন সেই আইনকে পাশ কাটাইতে না পারে, তাহা নিশ্চিত করা অবশ্যই সরকারের, অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব। কিন্তু, অতীতে যাহা ঘটিয়া গিয়াছে, তাহাকে বদলাইয়া দেওয়ার চেষ্টা করে, অথবা অতীতের হিসাব মিটাইয়া লহিতে চাহে, এমন কোনও আইন নৈতিক ভাবে সিদ্ধ নহে। জেনারেল অ্যান্টি-অ্যাভয়েড্যান্স রুল এই কারণেই প্রত্যাহার্য। ক্রিকেটের ভাষায় বলিলে, পালানিয়াপ্পান চিদম্বরম প্রথম ওভারটি দক্ষতার সহিত সামলাইয়াছেন। খেলা শেষ হইলে বোঝা যাইবে, তাঁহার রান কত হইল। |