সরকার পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নিলে অসম্ভব কঠিন হয়ে যাবে শিল্পের জন্য জমি পাওয়া। বিশেষত বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে। যেখানে প্রয়োজন এক লপ্তে বেশি জমি। আর তা না-পেলে থমকে যাবে বহু প্রকল্প। তৈরি হবে না কাজের সুযোগ। বসে যাবে দেশের অর্থনীতির চাকাও।
এই আশঙ্কার কথা তুলে ধরে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রকে ফের সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার আর্জি জানাল বণিকসভা সিআইআই। সেই সঙ্গে জমি কেনার পদ্ধতি থেকে শুরু করে পুনর্বাসন প্রকল্প পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে মনমোহন-সরকারের কাছে ছ’টি প্রস্তাব রেখেছে তারা।
জমি অধিগ্রহণ নিয়ে কেন্দ্র যেমন নতুন বিল আনার দিকে এগোচ্ছে, তেমনই এ নিয়ে ইতিমধ্যেই বিলের খসড়া তৈরি করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এখনও বিধানসভায় তা পেশ করা না হলেও, অনেকের মতে তা কিছু বিষয়ে কেন্দ্রের বিলের থেকে কড়া। কারণ, পুনর্বাসন প্যাকেজ নিয়ে কেন্দ্রের প্রস্তাবের সঙ্গে রাজ্য কার্যত একমত হলেও, জমি অধিগ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে এখনও পর্যন্ত আরও শক্ত অবস্থানে অনড় রয়েছেন মমতা।
যেমন, বেসরকারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ জমি-মালিকের সম্মতি মিললে, বাকি ২০ শতাংশ জমি জোগাড়ে মাঠে নামার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কেন্দ্র। একই রকম পথ খোলা রাখা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের ক্ষেত্রেও। কিন্তু এই দু’ধরনের প্রকল্পেই এক ছটাক জমিও তারা অধিগ্রহণ করবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে এ রাজ্যের তৃণমূল সরকার। অর্থাৎ শিল্প গড়তে ১০০% জমি জোগাড়ের দায়িত্ব সংস্থারই।
তাই এ রাজ্যের শিল্পমহলের আশঙ্কা, মুখ্যমন্ত্রী এই অবস্থানে অনড় থাকলে, বড় বা মাঝারি শিল্প গড়া কার্যত অসম্ভব হয়ে যাবে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে। যেখানে সিংহভাগ জমিই ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত। তাই মালিকের সংখ্যাও অগুন্তি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, এখন প্রস্তাবিত বিলের খসড়ায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন করার কথা ভাবছে রাজ্য।
সংসদে বাদল অধিবেশন শুরু হচ্ছে বুধবারই। এবং সেখানে সম্ভবত ২০১১ সালের জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বিল আনতে চলেছে মনমোহন-সরকার। তাই ঠিক তার আগের দিন, মঙ্গলবার এ নিয়ে শিল্পমহলের দাবি-দাওয়া আবারও কেন্দ্রের কানে পৌঁছে দিতে চেয়েছে সিআইআই। বণিকসভাটির ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “অসংখ্য ছোট ছোট জমির মালিকের কাছ থেকে জমি কেনার দক্ষতা কর্পোরেট দুনিয়ার বিশেষ নেই। বিশেষত যেখানে অধিকাংশ জমিই অজস্র ছোট ছোট ভাগে ভাঙা এবং তাদের প্রামাণ্য নথিও তেমন নেই। তাই এই সমস্ত বাধা ডিঙিয়ে শিল্পের জন্য জমি নিতে সরকারের হস্তক্ষেপ একান্ত জরুরি।”
সার্বিক ভাবে এই বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি ছ’টি নির্দিষ্ট প্রস্তাবও দিয়েছে সিআইআই। সেগুলি হল
• অন্তত কিছুটা শিথিল হোক সেচের আওতায় থাকা বহু-ফসলি জমি না-নেওয়ার কড়াকড়ি। কারণ তা না-হলে, কিছু কিছু রাজ্য যেমন শিল্পে পিছিয়ে পড়বে, তেমনই মুশকিল হবে পর্যাপ্ত খনিজ পদার্থ পাওয়া।
• বিলের প্রস্তাব অনুযায়ী জমি নিতে হলে, খরচ বাড়বে ৩ থেকে সাড়ে তিন গুণ। যা বিপুল বোঝা হবে শিল্পের ঘাড়ে। তাই জমি-মালিককে বর্তমান দামের কত গুণ দিতে হবে বা মোট ক্ষতিপূরণের অঙ্ক কত হবে, দুই-ই পুনর্বিবেচনা করুক কেন্দ্র।
• বিলের প্রস্তাব মানলে পুনর্বাসনের খরচও বাড়বে প্রায় ৩ গুণ। তাই সকলকে একই হারে টাকা দেওয়ার পরিবর্তে কোন পরিবারের সত্যিই কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা বিবেচনা করুক কেন্দ্র। পুনবার্সনের প্যাকেজ তৈরি হোক সেই অনুযায়ী।
• কেনার ১০ বছরের মধ্যে ব্যবহার না-করলে, জমি ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও অসুবিধায় ফেলবে শিল্পকে। কারণ, ভবিষ্যতের সম্প্রসারণ প্রকল্পের কথা মাথায় রেখে সাধারণত কিছুটা বেশি জমি কিনে রাখে অধিকাংশ সংস্থা। কিন্তু তা যে সব সময় ১০ বছরের মধ্যেই হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? সুতরাং এই বিষয়টিও ভেবে দেখুক কেন্দ্র।
• বিলের শর্ত অনুযায়ী, প্রকল্পের জন্য বেসরকারি সংস্থা অন্তত ৮০% জমি-মালিকের সম্মতি জোগাড় করতে পারলে, তবেই বাকি জমি অধিগ্রহণ করে দেবে কেন্দ্র। যে কোনও বড় প্রকল্পে তা জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে যাবে সব সংস্থারই। সেই কারণে ওই সম্মতি জোগাড়ের বাধ্যবাধকতা ৬০ শতাংশে নামিয়ে আনা জরুরি।
• জমি অধিগ্রহণ আইনের ১১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, মূল্য (অ্যাওয়ার্ড) ঘোষণার সময় জমি কেনার প্রক্রিয়া থমকে গেলে, আবার গোড়া থেকে তা শুরু হওয়ার কথা। নয়া নিয়মে এই শর্ত না-রাখার বন্দোবস্ত করুক কেন্দ্র।
বণিকসভাটির অভিযোগ, শুধু বেসরকারি প্রকল্পের জন্য নয়। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের জন্য জমি নেওয়ার পথও একই ভাবে কঠিন করার কথা বলেছে সংসদের গ্রামোন্নয়ন সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। তেমন হলে ধাক্কা খাবে বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্প। তাই এই সব দিক বিচার করে শিল্প ও কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখেই কেন্দ্র বিলের সংশোধনী বিবেচনা করবে বলে সিআইআইয়ের আশা। |