|
|
|
|
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি |
কৌতূহল নিরসনে পড়শি গ্রহে,
অনিতার স্বপ্ন ছুঁয়ে উদ্বেল নাসা
শুভাশিস ভট্টাচার্য • কলকাতা |
|
|
সাত মিনিটের আতঙ্ক বদলে গেল সাত মিনিটের জয়োল্লাসে। আর সেই উল্লাস নিয়েই ফোনে ধরা দিলেন বঙ্গতনয়া, অনিতা সেনগুপ্ত। সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নটাকে কয়েক মুহূর্ত আগে ছুঁয়ে ফেলেছেন তিনি। এবং তাঁর সতীর্থরা। নাসার মঙ্গলযান (রোভার) কিউরিওসিটি নিখুঁত ও মসৃণ ভাবে নেমে পড়েছে আমাদের প্রতিবেশী গ্রহে।
প্রতিটি শব্দে উচ্ছ্বসিত অনিতা। তিনি বললেন, “অবিশ্বাস্য রকমের আনন্দ হচ্ছে। প্রযুক্তির দিক দিয়ে এটা ছিল একটা বিশাল লড়াই। সেই লড়াইটা জিতেছি। এই মুহূর্তে কী বলব? কোনও শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।”
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের জেট প্রপালশান ল্যাবরেটরির সিনিয়র ইডিএল ইঞ্জিনিয়ার অনিতা। ইডিএল মানে এন্ট্রি, ডিসেন্ট, ল্যান্ডিং, অর্থাৎ মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে রোভার কিউরিওসিটি প্রবেশ, নীচে নামা ও আলতো ভাবে মাটি ছোঁয়ার যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করেছেন যাঁরা, অনিতা তাঁদেরই অগ্রণী সদস্য। কিউরিওসিটির নামার কিছু পরপরই আজ আনন্দবাজারকে তিনি জানালেন, “সব কিছু একেবারে ঠিকঠাক ভাবে হয়েছে। সব যন্ত্রপাতি পরিকল্পনা মাফিক কাজ করেছে। প্যারাশ্যুট তার দায়িত্ব পালন করেছে নিখুঁত ভাবে। ছবি তুলে পাঠাতে পাঠাতে রোভার ছুঁয়েছে মঙ্গলের মাটি।” অথচ নিজেই নিজের স্বপ্নপূরণের খবরটা এত চটজলদি দিতে পারবেন কি না সে ব্যাপারে কিছুটা সন্দেহ ছিল অনিতার। আগেই বলে রেখেছিলেন, “ওই সময় কিছু বিধিনিষেধ থাকবে। সংবাদমাধ্যমকে যা কিছু খবর পেতে হবে সরকারি সূত্র থেকেই।” |
|
কিউরিওসিটি রোভার মাটি ছোঁয়ার পর। নাসার জেট প্রপালশান গবেষণাগারে। ছবি: রয়টার্স |
কিন্তু আবেগের বিস্ফোরণের সামনে সরকারি বিধিনিষেধ কী করবে?
পাসাডেনায় নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির মিশন কন্ট্রোল রুমে উল্লাসের বোমাটা যখন ফাটল ভারতে তখন সোমবার বেলা ১১টা ২ মিনিট। ওখানে রবিবার রাত ১০টা ৩২। কয়েক মুহূর্ত আগেই ছিল দম বন্ধ করা অবস্থা। তাবড় বিজ্ঞানীদের কেউ তখন দাঁত দিয়ে নখ কাটছেন। কেউ মুখের সামনে হাত নিয়ে কম্পিউটারে চোখ রেখে স্থির। কিউরিওসিটি মঙ্গলের মাটি ছুঁতেই চেঁচিয়ে উঠলেন এক সঙ্গে। কার্যতই হাত-পা ছুড়ছেন তাবড় বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদ ও কর্তারা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরছেন আনন্দে। কেউ কেউ তো কেঁদেই ফেললেন। ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ বা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান কিংবা আইপিএলের কেকেআর-পুণের মধ্যে লড়াইয়ের পরে কলকাতার কোনও কর্পোরেট অফিসও যেমন হঠাৎ পাল্টে যায়, প্রায় সেই রকমই লাগছিল দৃশ্যটা। বিশ্বকাপ জেতা উচ্ছ্বসিত সমর্থকদের মতোই পাগলপারা সবাই। আশ্চর্য এক ‘মেল্টিং পট’ আমেরিকা! সাদা কালো হলদে বাদামি, মঙ্গোলয়েড, নর্ডিক, এশীয় কত ধরনের মুখ। এর মধ্যে বাঙালি মেয়েটা কোথায়? খুঁজছিল চোখ। তারই ফাঁকে বার্তা এল অনিতার মোবাইল থেকে। রোভারের কৌতূহলী চোখ নামতে নামতে যে ছবি তুলেছে তাঁর বর্ণনা। “আরে একটা ছবিতে সূর্যকে দেখতে পাচ্ছ! আর একটায় তো ‘মেয়েটার’ ছায়াও দেখা যাচ্ছে দিব্য।” হ্যাঁ, ইংরেজিতে ‘SHE’-ই লিখেছেন অনিতা। নিজের একটু বড় হওয়া মেয়েকে প্রথম বার দূর দেশে পাঠানোর পরে তার পৌঁছসংবাদ পাওয়ার মধ্যে যে উৎকণ্ঠা, স্বস্তি ও তৃপ্তির মিশেল থাকে, তার সবটাই যেন ধরা দিল অনিতার কথায়। নাসার মঙ্গল বিজ্ঞান গবেষণাগারের (এমএসএল) প্রজেক্ট ম্যানেজার পিটার থিসিংগার বলেছেন, “কিউরিওসিটি মঙ্গলের মাটি থেকে আমাদের সঙ্গে কথা বলছে। অবতরণের যাবতীয় ঝক্কি পেরিয়ে এখন এক নতুন অভিযান শুরু হবে।” |
|
কী রকম সেই অভিযান?
|
তখন প্যারাশু্যটে ঝুলে নামছে কিউরিওসিটি। |
নাসা জানিয়েছে, মাটিতে নামার পরই মঙ্গলের একটি ‘ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল’ ছবি পাঠিয়েছে কিউরিওসিটি। পরের কয়েক দিনে আরও এ রকম কয়েকটি ছবি পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীদের আশা। প্রথম সপ্তাহে কিউরিওসিটি তার মূল অ্যান্টেনা খুলবে। যার মধ্যে আছে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা-সহ একাধিক যন্ত্র। প্রথম সপ্তাহটা এক জায়গায় দাঁড়িয়েই চার পাশের ছবি তুলে পাঠাবে কিউরিওসিটি। চলাফেরা শুরু করবে এ মাসের শেষ দিকে। সেপ্টেম্বর মাঝামাঝি গিয়ে প্রথম মাটির নমুনা সংগ্রহ করবে সে। অক্টোবরে শুরু করবে পাথর খোঁড়ার কাজ। এ সব কাজ সে করবে পরমাণু-জ্বালানির জোরে। তেজস্ক্রিয় মৌল (প্লুটোনিয়াম) শক্তি জোগাবে তাকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে চলবে। ‘গেল’ নামে প্রায় ১৫৪ কিলোমিটার চওড়া একটি গহ্বরে সন্ধান চালাবে এই রোভার।
নাসার এই সাফল্যে জুড়ে রয়েছে ইওরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইএসএ)। ইএসএ জানিয়েছে, এ দিন কিউরিওসিটির অবস্থানের সঙ্কেত তারাও রেকর্ড করেছিলেন এবং তা নাসায় পাঠানো হয়। ইএসএ-র সৌর এবং গ্রহ অভিযানের প্রধান পাওলো ফেরি বলেন, “নির্বিঘ্ন অবতরণের জন্য নাসার বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন।” ইএসএ-র মার্স এক্সপ্রেস স্পেসক্রাফ্ট অপারেশনস ম্যানেজার মিশেল ডেনিস বলেন, “দীর্ঘ ২৮ মিনিট ধরে কিউরিওসিটির গতিবিধি লক্ষ করছিলাম।” মঙ্গলে কিউরিওসিটির পদার্পণের খবর মিলেছিল মঙ্গলের কক্ষপথে ওডিসি অরবিটার এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় নাসার ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কের অ্যান্টেনা স্টেশন থেকে। |
|
স্বস্তি। নাসার কন্ট্রোল রুমে অনিতা সেনগুপ্ত। নিজস্ব চিত্র |
২০৩০ সালে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে নাসার। এ দিনের সাফল্য সেই পরিল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে বলেই মনে করেন বিজ্ঞানীরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বক্তব্য, “এ দিনের সাফল্য অদূর ভবিষ্যতে মার্কিন মহাকাশচারীদের দেশীয় সংস্থার তৈরি যানে চাপিয়ে মহাকাশে পাঠানোর পরিকল্পনা রূপায়ণে সাহায্য করবে। এতে জনগণের অর্থ দেশের বাইরে যাবে না। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে আমাদের বড় ধরনের বিনিয়োগ সব সময়ই অন্যদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
দেশের প্রেসিডন্ট হিসেব ওবামা আমেরিকার কথা বলবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। বাংলা প্রায় না জানা সে দেশের বাঙালি মেয়েটি কিন্তু বললেন, “জেপিএল-এ আমাদের কাছে, নাসার কাছে এটা এক বিশাল সাফল্য। বিশাল সাফল্য গোটা মানবজাতির কাছেও।” |
|
|
|
|
|