হারানো জমসমর্থন ফিরে পেতে মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে ‘বন্ধু’র মতো। ‘প্রভু’র মতো ব্যবহার চলবে না! রাজ্য সরকারের মোকাবিলায় ‘ঘুরে দাঁড়াতে’ দলের কর্মীদের এমন দাওয়াই-ই দিলেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর মতে, রাজ্যে একটি ‘ভয়াবহ সরকার’ চলছে। যাদের কোনও নীতি এবং দিশার ঠিক নেই। এই সরকারের মোকাবিলায় রুখে দাঁড়াতে গেলে আরও বেশি মানুষের সমর্থন প্রয়োজন। পরপর কয়েকটি নির্বাচনে বামেদের জনসমর্থনের যে ভিত আলগা হয়ে এসেছে, তাকেই পুনরুদ্ধারের কথা বলছেন বুদ্ধবাবু। যা তাঁর নিজেরই মতে ‘খুব কঠিন কাজ’! কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে দলের কর্মীদের প্রতি বুদ্ধবাবুর আহ্বান, সরকার এবং শাসক দলের আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে মানুষের কাছেই ফিরে যেতে হবে তাঁদের।
মুজফ্ফর আহমেদের ১২৪তম জন্মদিন উপলক্ষে রবিবার মহাজাতি সদনের সভায় বুদ্ধবাবু বলেছেন, “যে মানুষ আমাদের সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের একাংশ দূরে সরে গিয়েছেন। সরে গিয়েছেন আমাদেরই ভুলে। তাঁদের বোঝাতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে। খুব কঠিন কাজ! তাঁদের বন্ধুর মতো বোঝাতে হবে, প্রভুর মতো নয়! মানুষকে ফিরিয়ে আনতে না-পারলে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা সম্ভব হবে না।” রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের ব্যাখ্যা, অতীতে সিপিএমের নেতা-কর্মীদের আচরণ যে ‘প্রভুর মতো’ হয়ে উঠেছিল এবং ক্ষমতা হারানোর পরেও সেই অভ্যাস যে পুরোপুরি বদলায়নি, বুদ্ধবাবুর বক্তব্যেই তা স্পষ্ট। |
দলের সম্মেলন-পর্বে এই আচরণের ত্রুটি শোধরানোর কথা নিয়ম করে বলতেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। পঞ্চায়েত ভোটের লক্ষ্যে দলকে প্রস্তুত করার জন্য নতুন ভাবে সেই পরামর্শই এ দিন দিয়েছেন তিনি।
আত্মসমালোচনার পাশাপাশিই কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের প্রতি তীব্র আক্রমণও ছিল এ দিন বুদ্ধবাবুর বক্তব্যে। রাজ্যে কৃষি ক্ষেত্রে গভীর সঙ্কট এবং শিল্পায়নের অগ্রগতি ‘শূন্য’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ করে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কটাক্ষ, “এই সরকারের মনোভাব হচ্ছে, রাস্তায় কিছু আলো লাগাও। তা-ও সব জ্বলছে না শুনছি! কিছু ব্রিজে নীল রং করে দাও! আর মাঝেমাঝেই উৎসব কর! আলো, রং, উৎসব এটা কি ক্লাব চলছে? এই ভাবে সরকার চলে না। গ্রামের হাহাকার কোথায় পৌঁছেছে!” আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং মহিলাদের উপরে আত্রমণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে বুদ্ধবাবু আরও বলেছেন, “অতীতে মহিলাদের উপরে কোনও ঘটনাই ঘটেনি, এমন দাবি করতে পারব না কেউই। কিন্তু একটা ঘটনা ঘটলে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্ধ করা যেত। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে কাজ করা যায়। কিন্তু কিচ্ছু হয়নি, ছোট্ট ঘটনা, চক্রান্ত হচ্ছে এই কথাগুলোর মানে কী? রাজনৈতিক সততা ছাড়া এই অবস্থা আটকানো যাবে না।”
রাজ্যে সার্বিক গণতন্ত্রের উপরে আঘাতের কথা উল্লেখ করে সিপিএমের আর এক পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেন বলেছেন, কমিউনিস্টরা কোনও ভাবেই ‘আত্মসমর্পণ’ করবে না। রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপমবাবুর কথায়, “বামফ্রন্ট সরকার যখন প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল, জ্যোতি বসু বলেছিলেন, মহাকরণের অলিন্দ থেকে এই সরকার চলবে না। আর এখন মহাকরণের অলিন্দও নয়, মহাকরণের একটা ঘরে যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে! ব্যক্তিতন্ত্র চলছে! সেই জন্যই গণতন্ত্রের উপরে এত আক্রমণের কোনও প্রতিকার নেই।” রাজ্য সরকারের নীতি ও নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আরও কর্মসূচি নেওয়ার কথা বলে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছেন, “এখন তো টিভি-তে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘চলছে না-চলবে না’ বলা যাবে না! আমিও জোর দিয়ে বলতে চাই, মানুষের সংগ্রাম চলছে-চলবে!”
আর্থিক নীতির প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারকে একেবারেই ছেড়ে কথা বলেননি বুদ্ধবাবু। এবং এই প্রসঙ্গেই প্রায় ‘ব্যজস্তুতি’র সুরে ‘পাশে’ দাঁড়িয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের! বুদ্ধবাবুর কথায়, “নতুন রাষ্ট্রপতি বলেছেন, চুঁইয়ে পড়ার তত্ত্ব চলবে না। জানি না, এটা সমালোচনা না আত্মসমালোচনা! যা-ই হোক, সত্যি কথাটা বলে ফেলেছেন!” বুদ্ধবাবুর ব্যাখ্যা, “শুধু তেলা মাথায় আরও তেল দিলে গরিবের উপরে তেল চুঁইয়ে পড়বে না। কোনও দেশেই এ জিনিস খাটেনি। এটাই তো আমরা বহু কাল বলেছি। বহু নেতাই বলেছেন!” ঘটনাচক্রে, সিপিএমের অন্দরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রণববাবুকে সমর্থনের অন্যতম মুখ্য প্রবক্তা ছিলেন বুদ্ধবাবুই। ‘আক্রান্ত’ হয়েও কেন্দ্রের আর্থিক নীতি এবং রাজ্যের সার্বিক দুরবস্থার প্রতিবাদে তাঁদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ‘প্রত্যয়’ই দলের কর্মী-সমর্থকদের শুনিয়েছেন বুদ্ধবাবু। বলেছেন, “আমরা জমি ছেড়ে যাব না। মানুষের উপরে আস্থা রেখে এগোতে হবে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। গরিব মানুষ জানেন, লাল ঝান্ডা ছাড়া তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তাঁদের নিয়ে, বৃহত্তর জনসমাবেশ ঘটিয়েই এই ভয়াবহ সরকারের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারব।” |