সেই উইম্বলডন। সেই চেনা ঘাস-মাটি। কিছুই তো বদলায়নি। মাত্র এক মাস আগে এই অল ইংল্যান্ড ক্লাবের সেন্টার কোর্টেই উইম্বলডন ফাইনালে হেরে ঝরঝর করে কেঁদেছিল অ্যান্ডি মারে। রবিবার যেন সেই কান্নারই শোধ তুলল ও। উইম্বলডন ফাইনালের প্রতিপক্ষ রজার ফেডেরারকে অলিম্পিক ফাইনালে স্ট্রেট সেটে উড়িয়ে দিয়ে সোনা ছিনিয়ে নিল মারে। সেই সেন্টার কোর্টেই।
কখনও কখনও মনে হচ্ছে, মারের সোনা জেতার চেয়েও বেশি তাৎপর্যের বোধ হয় ফেডেরারের হেরে যাওয়াটা। চার সপ্তাহ আগের এ রকমই এক রবিবারে মারেকে ঘরের মাঠে হারিয়ে ফেডেরার সপ্তম উইম্বলডন এবং কেরিয়ারের ১৭তম গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব জিতে টেনিসে অমরত্ব লাভ করেছে। এক মাসের মধ্যে সেই লোক একই কোর্টে, একই প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হারল। বিগ ফাইনালে ফেডেরারকে স্ট্রেট সেটে ২-৬, ১-৬, ৪-৬ উড়ে যেতে দেখা আর বাঘকে নিরামিষ খেতে দেখা এক ব্যাপার!
এ দিন ফাইনাল গেমে মারে যখন শেষ দু’টো পয়েন্ট স্রেফ ‘এস’ মেরে তুলে নিচ্ছে, তখনও সেন্টার কোর্ট জুড়ে কেমন একটা অদ্ভুত আবহাওয়া। লোকগুলো এক দিকে হতবাক। অন্য দিকে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত। মারে নিজেও তো জয়সূচক ‘এস’টা মেরে কেমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আনন্দে কোর্টে শুয়ে পড়া নেই, নেটের দিকে দৌড়ে যাওয়া নেই। বোধহয় উপলব্ধিটা এল একটু দেরিতে, যে ও দেশের জন্য একটা অলিম্পিকের সোনা জিতে ফেলেছে!
‘সংযত’ মারের চোখে আজও জল ছিল। তবে আনন্দাশ্রু। গ্যালারিতে ওর পরিবারের লোকেদের চোখও ছিল ভেজা। গ্যালারির সেই ভিড়ে যদিও মারের বিখ্যাত ট্যুর কোচ ইভান লেন্ডল নেই! |
কেননা অলিম্পিকটা পেশাদার সার্কিট নয়। তবে লেন্ডলের জন্যই সার্কিটের অন্যতম সেরা ব্যাকহ্যান্ড প্লেয়ার মারের ফোরহ্যান্ডও এই মুহূর্তে দারুণ শক্তিশালী। এ দিন ফোরহ্যান্ডে ও এমন কিছু দুর্ধর্ষ শট খেলেছে, যেগুলো মারতে পারলে সর্বকালের সেরা ফোরহ্যান্ড প্লেয়ার ফেডেরারও গর্বিত হত। প্রথম সেটে ৪-২ এগিয়ে থাকা অবস্থায় মারের টানা ৯টা গেম জেতাই ফাইনালের টার্নিং পয়েন্ট।
ফেডেরারকে দেখে আমার মনে হল, মাত্র এক দিন আগে চার ঘণ্টার সেমিফাইনাল খেলার ধকল এই তিরিশ বছর বয়সে পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। হয়তো সে কারণে কোর্টে সামান্য স্লো দেখিয়েছে। মারেও আগের দিন পরপর দুটো মিক্সড ডাবলস খেলে এ দিন সিঙ্গলস ফাইনালে নেমেছিল। কিন্তু অর্ধেক কোর্টে ডাবলস খেলার ধকল আর সিঙ্গলসে শুধু একটা সেটই আড়াই ঘণ্টা নিজেকে নিংড়ে ১৯-১৭ গেমে জেতা এক জিনিস নয়। তা ছাড়া মারের বয়সটাও পাঁচ বছর কম।
উইম্বলডনে অলিম্পিক টেনিস দেখতে আমার কেমন অদ্ভুত লাগছিল। চিরাচরিত সাদা পোশাকের বদলে প্লেয়ারদের রঙিন পোশাক। পয়েন্ট চলার মধ্যেও দর্শকরা চিৎকার করছে নিজের-নিজের দেশের প্লেয়ারের নাম ধরে। বিখ্যাত উইম্বলডন-ঐতিহ্যের বদলে কেমন যেন এনবিএ ম্যাচের মেজাজ। রয়্যাল বক্সে বাধ্যতামূলক স্যুটের বদলে টি-শার্ট পরা ভিআইপি। ফেডেরার কি সে জন্যই ওর ‘দ্বিতীয় ঘরে’ও কিছুটা ডি-ফোকাস্ড হয়ে পড়ল অলিম্পিক ফাইনালে? অলিম্পিক সিঙ্গলসে সোনা পেলে ফেডেরারের গোল্ডেন গ্র্যান্ড স্ল্যাম হত। আগাসি, নাদালের মতো। কিন্তু সেটা সম্ভবত অধরাই থেকে যাচ্ছে সর্বকালের সেরা টেনিস তারকার। চার বছর পর রিও অলিম্পিকে ৩৪ বছর হয়ে যাওয়া ফেডেরার নিশ্চয়ই খেলবে না। তা সত্ত্বেও এ বার অলিম্পিকে জকোভিচের খালি হাতে ফেরা বা উইলিয়ামস বোনেদের রেকর্ড সংখ্যক চারটে করে সোনা জেতার চেয়েও ফেডেরারের হার নিয়ে যেন চর্চা বেশি। এমনকী মারের সোনা জয় নিয়ে ব্রিটিশরা আবেগে ভাসার মধ্যে নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবে যে, উইম্বলডন আর অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হওয়া এক নয়।
দু’দশক পৃথিবী চষে আন্তর্জাতিক টেনিস খেলার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, টেনিস প্লেয়ারদের কাছে গ্র্যান্ড স্ল্যাম হল আসল, তার মধ্যেও আবার উইম্বলডন হল সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। আমাদের সময় তো অলিম্পিকে টেনিস খেলাটাই ছিল না। কিন্তু আমার কোনও দিন অলিম্পিক খেলতে পারিনি বলে দুঃখ ছিল না। অনেকেই হয়তো একমত হবেন না, কিন্তু আমার মতে ফেডেরারের এক মাস আগে সপ্তম বার উইম্বলডন জেতার জন্য যে মোটিভেশন ছিল, এ দিন অলিম্পিক ফাইনাল জেতার জন্য সেই মোটিভেশন হয়তো ছিল না। সোমবারই টরন্টো মাস্টার্স খেলতে ফেডেরার-মারেরা রওনা দেবে। আর কোনও অলিম্পিক স্পোর্টে পেশাদার সার্কিটের এত বড় হাঁ নেই। টেনিসে যেমন আছে। আর একটা ব্যাপার হল, উইম্বলডন ফাইনালে মারের ওপর অনন্ত চাপ ছিল। ঘরের ছেলে হিসেবে দীর্ঘ সাত দশক পর সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চাপ। কিন্তু একই কোর্টে অলিম্পিক ফাইনালে মারে অনেক খোলা মনে খেলেছে। তবে এটাও মানতে হবে, এ দিন বোধহয় সব কিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল দেশ ‘ব্যক্তি’ মারে বা ফেডেরার নয়। দর্শকাসনে হাতে হাতে ইউনিয়ন জ্যাক। সোনার পদকটা গলায় ঝুলিয়ে সেই পতাকা গায়ে জড়িয়েই দাঁড়িয়ে ছিল মারে। সব মিলিয়ে অন্য রকম ছবি।
তবে জানি, এই ম্যাচটাই পরের বছর আবার উইম্বলডন ফাইনালে হলে হয়তো অন্য ছবি দেখব। |