বহরমপুরের ২৫টি ওয়ার্ডে যত পুরনো জরাজীর্ণ বাড়ি রয়েছে তার তালিকা তৈরির ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত উদ্যোগী হয়েছে বহরমপুর পুরসভা। এজন্য তারা ১০ জনের একটি কমিটিও তৈরি করেছে। বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে ওই কমিটি পুরনো, বিশেষ করে সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে এমন জরাজীর্ণ বাড়ির তালিকা তৈরি করবে এবং সব দিক খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, “সম্পত্তি নিয়ে বিভিন্ন শরিকের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে দ্বন্দ্বের কারণে পুরনো বাড়ি সংস্কারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও পুরনো বাড়ির দীর্ঘ দিনের ভাড়াটিয়ারা এখন আর উঠতে চাইছেন না, তাতেও বাড়ি সংস্কারে বাধা তৈরি হচ্ছে। এদিকে সংস্কার না হওয়ায় ওই বাড়িগুলি বিপজ্জনক অবস্থায় হয়েছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের কাছ থেকে ওই সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগও পুরসভায় জমা পড়েছে।”
বৃহস্পতিবার খাগড়া এলাকায় হনুমানের দাপাদাপিতেই একটি বাড়ির ইট খসে মাথায় পড়ে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও এক জন। পুরপ্রধানের কথায়, “বৃহস্পতিবারের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। ওই বাড়ির মালিকদের ডেকে অবিলম্বে ভবন সংস্কারের কথা বলেছি।’’ ষোলোশো সালের মাঝামাঝি থেকেই অট্টালিকা-ইমারত তৈরি করে কাশিমবাজার-সৈয়দাবাদ এলাকায় নতুন সচ্ছল জনপদ গড়ে ওঠে। কিন্তু পরে অষ্টাদশ শতকের সাতের দশকে কাশিমবাজার, সৈয়দাবাদ, কালিকাপুর অঞ্চলের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, তেজারতির কারণে অধিকাংশ ব্যবসায়ী কলকাতায় চলে যান। এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষয়ে যেতে থাকল এবং মুর্শিদাবাদ সিল্ককে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্য চলত, তা-ও হ্রাস পেতে থাকল। দেশীয় যে সব জমিদার কোম্পানির বেতনভুক কর্মী ছিলেন, তাঁরা আর্থিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। তাঁদের উত্তরাধিকারীদের পক্ষে ওই বিশাল অট্টালিকা-ইমারত রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। |
কাশিম খাঁ, সৈয়দ খাঁ |
পুরপ্রধান উবাচ |
মুর্শিদাবাদ যখন রাজধানী, তারও আগে কাশিমবাজার, সৈয়দাবাদ, কালিকাপুর অঞ্চল গড়ে ওঠে। ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদ বলেন, “সুবাদার কাশিম খাঁর নামানুসারে যেমন কাশিমবাজারের নামকরণ হয়, তেমনই আর এক সুবাদার সৈয়দ খাঁর নামানুসারে সৈয়দাবাদের নামকরণ হয়। সৈয়দ খাঁ পনেরোশো সালে সুবাদার ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই বোঝা যায় ওই জনপদ কত পুরনো!” ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে কাশিমবাজারে প্রথম কারখানা প্রতিষ্ঠা করে লন্ডন কোম্পানি। |
“বৃহস্পতিবারের ঘটনার পরে বহরমপুর পুরসভার তরফে ১০ জনের কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। খাগড়ার ওই ঘটনা পুরনো বাড়িগুলি সম্বন্ধে আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। আমরা তার দায় এড়াতে পারি না। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে পুরনো বাড়িগুলি সংস্কারের জন্য প্রথমে বর্তমান মালিকদের কাছে অনুরোধ করা হবে। তারা যদি গুরুত্ব না দেন তাহলে পুরসভা নিজস্ব ক্ষমতা বলে ওই পুরনো জরাজীর্ণ বাড়িগুলি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে।” |
|
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশ কিছু ঐতিহাসিক বাড়িও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। কাশিমবাজার এলাকায় মহাজন টুলিতে বেশ কিছু প্রাচীন বাড়ি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। বহরমপুরের প্রবীণ নাগরিক তথা প্রাবন্ধিক সাবিত্রীপ্রসাদ গুপ্ত বলেন, “গোরাবাজার রুটিমহলে প্রখ্যাত আইনজীবী তথা কৃষ্ণনাথ কলেজে অধ্যাপক গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের শতবর্ষ প্রাচীন বাড়িটিও গুরুত্বপূর্ণ। ওই বাড়িতে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ও গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ওই বাড়িতে বাস করতেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ওই বাড়িতে কিছু কাল বাস করেছেন।” পুরপ্রধান বলেন, “বাড়িটি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওই বাড়িতে বেসরকারি একটি স্কুল চলছে। বর্তমান মালিকপক্ষ বাড়ি সংস্কারে উদ্যোগী হলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ তা ছাড়তে নারাজ। ওই বিষয়ে ৮ অগস্ট শুনানির জন্য উভয়পক্ষকে পুরসভায় ডাকা হয়েছে।”
একই ভাবে সৈয়দাবাদ এলাকায় বহরমপুর পুরসভার প্রথম চেয়ারম্যান বৈকুন্ঠ সেনের বাড়ি, মহরানি স্বর্ণময়ীর গঙ্গাস্নানের বাড়ির (পরে সেখানে জেলা গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হয়। এখন শহর গ্রন্থাগার চলছে) হালও শোচনীয়। খাগড়ার ৬ নম্বর দিনু সান্যালের গলিতে যে বাড়িটি যোগমায়া বাড়ি নামে পরিচিত, সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র বাস করতেন। সেখানে আগে মূক ও বধির স্কুল চলত। ভগ্নপ্রায় ওই বাড়িতে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে। খাগড়ায় মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ব্রজভূষণ গুপ্তেরও বাড়িও সামনের অংশ জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে। যে কোনও সময়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ সোমেশ রায় বলেন, “বহরমপুরের সমস্ত বিপজ্জনক বাড়িগুলি ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে পুরসভা ও প্রশাসনকে যৌথ উদ্যোগ করতে হবে। আচমকা কোনও বাড়ি ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় কিন্তু তারা এড়াতে পারবে না। পুরসভা-প্রশাসনের তরফে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।” |