অণ্ণা হজারে রাজনৈতিক দল গঠন করিতে চলিয়াছেন, এই সংবাদ বিস্ময় হইতে আশাভঙ্গ, ক্রোধ হইতে ব্যঙ্গ বহু ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিয়াছে। এই বিরূপতার মূলে রহিয়াছে যুক্তিহীন আবেগ। যাঁহারা অণ্ণার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ, তাঁহারা এই প্রবীণ সমাজকর্মীর মধ্যে এক জন মসিহাকে খুঁজিয়াছিলেন। তাঁহাদের বিচার এই রূপ যে, ভারতের রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত, কার্যত দুর্নীতির নামান্তর। এই রাজনীতির কারবারিরা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করিতে পারিবেন না, চাহিবেনও না। তাহার জন্য প্রয়োজন এক জন ‘মহান’ এবং ‘লোকোত্তর’ নায়কের, যিনি রাজনীতির বাহিরে থাকিয়া, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠিয়া সমাজের পঙ্কোদ্ধারে নেতৃত্ব দিতে পারিবেন। তাঁহারা অণ্ণা হজারের মধ্যে সেই কাঙ্ক্ষিত নায়ককে খুঁজিয়া পাইয়াছেন। অণ্ণা নিজেও, দৃশ্যত, সেই মহিমা স্বীকার করিয়া পুলকিত হইয়াছেন, নিজেকে দ্বিতীয় গাঁধী রূপে জনচক্ষে প্রতিষ্ঠা করিতে তৎপর হইয়াছেন। (মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী রাজনীতির বাহিরে ছিলেন না, বরং আদ্যন্ত রাজনীতিক ছিলেন, কিন্তু তাহা ভিন্ন প্রশ্ন, অণ্ণা ও তাঁহার ভক্তরা গাঁধীজির ‘মহাত্মা’ ভাবমূর্তিটি অবলম্বন করিয়াছেন।) অণ্ণা হজারে তাঁহার অনশন মঞ্চে বসিয়া রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের মুণ্ডপাত করিবেন, তাহা শুনিয়া এবং তাহার প্রতিধ্বনি করিয়া ভক্তরা পবিত্র আত্মপ্রসাদ অনুভব করিবেন, ইহাই তাঁহাদের কল্পস্বর্গ। তিনি রাজনৈতিক দল গড়িলে সেই স্বর্গকল্পনা ভাঙিয়া যায়। তাই তাঁহারা বিচলিত।
এই কল্পনার কোনও যৌক্তিকতা নাই। ভারতীয় রাজনীতিতে ত্রুটির অন্ত নাই। দুর্নীতির প্রকোপ অনস্বীকার্য। কেবল আর্থিক দুর্নীতির প্রচলিত ধারা নহে, নানা ধরনের অনাচার এই রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বাঁধিয়াছে। দলীয় রাজনীতির রেষারেষি সেই অনাচারে অবিরত ইন্ধন জোগাইতেছে, তাহাও বলিবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ‘বাহির হইতে’ এই ক্লেদ দূর করিবার প্রকল্প বাস্তবোচিত নয়। রাজনীতিকে অস্বীকার করিয়া বা পাশ কাটাইয়া তাহার মান উন্নত করা সম্ভব নয়, ভিতর হইতে তাহার সংস্কারই একমাত্র উপায়। তাহার অর্থ নিশ্চয়ই এই নয় যে, সমাজ পরিবর্তন করিতে চাহিলেই সবাইকে আবশ্যিক ভাবে রাজনীতি করিতে হইবে। একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি না করিবার অধিকার রাজনীতি করিবার অধিকারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনীতিকে দূরে রাখিয়াই সংস্কার সম্ভব, এই ধারণাটি ভুল। অণ্ণা হজারের রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্তে সেই কারণেই আপত্তি বা ক্ষোভের কোনও সংগত কারণ নাই।
সমালোচকদের একটি অংশের বক্তব্য: অণ্ণা হজারের রাজনৈতিক উদ্যোগ সফল হইবে না। তাঁহাদের অনুমান সম্ভবত নির্ভুল। ‘দুর্নীতি হটাও’-এর স্লোগান ভিন্ন তাঁহাদের প্রকৃত কোনও কর্মসূচি নাই, তাঁহাদের সংগঠনের ভিতরেও হাজার ব্যাধি, হাজার গোলযোগ। রাজনৈতিক সাফল্যের পথে সেগুলি আরও বড় বাধা সৃষ্টি করিবে, এমন অনুমানের যথেষ্ট কারণ আছে। সর্বোপরি, অণ্ণা হজারে তাঁহার আপন অঞ্চলের সীমিত বলয়ে যে ধরনের কর্মকাণ্ড চালাইয়াছেন, ভারতীয় রাজনীতির বৃহত্তর মঞ্চে তাহা সম্পূর্ণ বেমানান, বিশেষত তাঁহার আত্মকেন্দ্রিক নেতৃত্বের ভঙ্গি গণতন্ত্রের অনুকূল নয়। কিন্তু এই সকল অনুমান বা আশঙ্কা সত্য হইলেও কিছু যায় আসে না। রাজনীতিকে সম্ভাব্যতার শিল্প বলা হইয়া থাকে। অন্য অর্থে তাহা অসম্ভাব্যতার শিল্পও বটে। রাজনীতি তাহার নিরন্তর টানাপড়েনের মধ্য দিয়াই নূতন সম্ভাবনা নির্মাণ করিয়া চলে, সাফল্য এবং ব্যর্থতা সেই বহুবিধ সম্ভাবনার দুইটি রূপ মাত্র। অণ্ণা হজারে সফল হইলেন কি না, তাহা গৌণ প্রশ্ন, কিন্তু বিভিন্ন মত এবং বিভিন্ন আন্দোলনকে আত্মস্থ করিয়াই একটি গণতান্ত্রিক রাজনীতি সার্থকনামা হইতে পারে। অন্য উপায় নাই। সেই কারণেই, রাজনীতির পরিসরে অণ্ণা হজারে স্বাগত। |