• কম বৃষ্টিতে চাষ-আবাদের ক্ষতি হচ্ছে এবং হবে। জানা কথা।
• কম বৃষ্টিতে ভূগর্ভে কম জল যাওয়ায় সেই জলস্তর পূর্ণ হবে না এবং তাতে চাষের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। এটাও জানা কথা।
• কম বৃষ্টির ধারা চলতে থাকলে হঠাৎ হঠাৎ মেঘপুঞ্জ ভেঙে আরও অতিবর্ষণ-বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আবহবিদদের আশঙ্কা। এটা ‘নতুন’ কথা।
জুন-জুলাইয়ের কম বৃষ্টির সঙ্গে শনিবার উত্তর কাশীতে মেঘপুঞ্জ ভেঙে পড়ার মধ্যে নির্দিষ্ট সমীকরণ খুঁজে পাচ্ছেন আবহবিদেরা। তাঁদের অনেকেরই আশঙ্কা, বর্ষা এ বার এতটাই সামঞ্জস্যহীন যে, আগামী দেড়-দু’মাসে এমন ঘটনা আরও ঘটতে পারে। আবহবিদদের এই ধারণা যে অমূলক নয়, তা বোঝাতে তাঁরা পরিসংখ্যানের সাহায্য নিচ্ছেন।
২০১০ সালের অগস্টে কাশ্মীরের লেহ-তে মেঘপুঞ্জ ভেঙে যে-বিপর্যয় ঘটেছিল, তার উদাহরণ দিয়েছেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজির এক গবেষক। ওই বছরই সেপ্টেম্বরে আরও দু’টি মেঘপুঞ্জ ভেঙে বিপর্যয় ঘটে। একটি উত্তরাখণ্ডের আলমোড়ায়। অন্যটি পুণেতে। ওই গবেষক দু’টিরই উল্লেখ করেছেন। ২০১০-এর জুন-জুলাইয়ে ২৫ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছিল সারা দেশে। সে-বারেও খরাজনিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায়।
২০০৫ সালের ২৬ জুলাই মাত্র আট ঘণ্টায় ৯৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি অচল করে দিয়েছিল মুম্বইকে। খুব কম সময়ে ওই ব্যাপক বৃষ্টির কারণও মেঘপুঞ্জ ভেঙে পড়া। সে-বছরও জুন-জুলাইয়ে অপেক্ষাকৃত কম বৃষ্টি হয়েছিল পশ্চিম ভারতে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজির সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, দেশের অনেক অঞ্চলেই জুন-জূলাইয়ের বৃষ্টির পরিমাণ ধারাবাহিক ভাবে কমে যাচ্ছে। যে-বার বৃষ্টির পরিমাণ খুব কমে যাচ্ছে, সেই বছর অগস্ট-সেপ্টেম্বরে পাহাড়ি এলাকায় হড়পা বান আর সমতলে খুব কম সময়ে অধিক বৃষ্টিতে নদীতে আকস্মিক জলস্ফীতির ঘটনা ঘটেছে।
এ বার বর্ষার প্রথম দু’মাসে স্বাভাবিকের থেকে প্রায় ২০ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে। দক্ষিণবঙ্গে এই ঘাটতি ২৫ শতাংশ ছুঁয়েছে। উত্তর-পশ্চিম ভারতে তা ৩৮ শতাংশ। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, পঞ্জাব, হরিয়ানা, গুজরাত, রাজস্থানের কয়েকটি এলাকায় ইতিমধ্যেই খরা-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আবহবিদেরা লক্ষ করছেন, অগস্টের শুরুতে মধ্য, উত্তর-পশ্চিম এবং পশ্চিম ভারতের কিছু অংশে হঠাৎই বৃষ্টির পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছে। এক আবহবিদের কথায়, “এখন এলোপাথাড়ি ব্যাট চালিয়ে ঘাটতি মেটাতে গিয়ে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটিতে ফলতে পারে বর্ষা। শনিবার উত্তর কাশীর মেঘপুঞ্জ ভেঙে যাওয়ার ঘটনাটা তাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।”
ওই আবহবিদের ব্যাখ্যা, বর্ষা হঠাৎই দিন কয়েকের জন্য সক্রিয় হয়ে যাওয়ায় বিশাল পরিমাণ মেঘ পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়েছিল। সেই মেঘপুঞ্জ পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে দৈর্ঘ্যে বিশাল লম্বা হয়ে যায়। ফলে তার পক্ষে আর জলকণা ধরে রাখা সম্ভব ছিল না। উল্লম্ব মেঘের দৈর্ঘ্য যত বেশি হয়, তার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ততই বাড়ে। ওই মেঘ ভেঙে প্রথমে ঝড় হয়। তার পরে তোড়ে বৃষ্টি নামে। যা অনেকটা কালবৈশাখীর সঙ্গে তুলনীয় বলে মন্তব্য করেছেন ওই বিশেষজ্ঞ।
|
ঘাটতি-বৃষ্টি কী ঘটাতে পারে |
• পাহাড়ি এলাকায় মেঘ ভেঙে বৃষ্টি
• পাহাড়ি নদীতে
হড়পা বান
• সমতলের নদী
উপচে বন্যা
• খরা পরিস্থিতি
• ভূস্তরের জলস্তর হ্রাস
•
জলাধারে জলস্তরে টান
•
বোরো চাষে জলাভাব |
|
আবহবিজ্ঞানীদের একাধিক সমীক্ষায়
দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৯ থেকে ২০০৯ এই ৩০ বছরে ভারতে বর্ষায় বৃষ্টির পরিমাণ কমেছে
অন্তত ৪.৫ শতাংশ। মৌসম ভবনের
এক অবসরপ্রাপ্ত আবহবিদ জানান, গত মে
মাসে দিল্লিতে আবহবিজ্ঞানীদের একটি আলোচনাচক্রে ভারতে বর্ষার ওই ‘অস্বাভাবিক’ আচরণ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল। জুন-জুলাইয়ে বৃষ্টি তুলনামূলক ভাবে কম হলে তার ফল কী হতে পারে, সেই ব্যাপারে আবহবিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করেন। সেখান থেকে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
জুন-জুলাইয়ের ঘাটতি-বৃষ্টির পরিণাম হতে পারে বহুমুখী।
• যদি অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা হয়, তা হলে পাহাড়ি এলাকায় মেঘপুঞ্জ ভেঙে পড়ার মতো ঘটনা ঘটে। তাতে আরও বেশি হড়পা বান হবে বলে আবহবিদদের আশঙ্কা। সমতলে নির্দিষ্ট এলাকায় খুব কম সময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি নেমে নির্দিষ্ট অঞ্চলকে ভাসিয়ে দিতে পারে। ছোট একটা অংশে হতে পারে ভয়াবহ বন্যা।
• আবার কোনও কোনও এলাকায় দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না-হয়ে খরা-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেখানে ভূস্তরের জল নেমে যেতে পারে। জলাধারের জলস্তর পর্যাপ্ত না-হওয়ায় বোরো চাষে সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু তার থেকেও যে-বিষয়টি নিয়ে আবহবিদেরা ভাবিত, তা হল, দু’টি ক্ষেত্রেই ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে জীবন আর সম্পত্তি নষ্টেরও। হড়পা বান এবং বন্যায় জল উপচে বেরিয়ে যায়। ফলে ভূগর্ভস্ত জলস্তর বাড়ার সম্ভাবনাও তেমন থাকে না।
• আবহবিদদের একাংশ মনে করছেন, বর্ষার এই ‘অদ্ভুত’ আচরণে বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণুর সক্রিয়তা বাড়বে। বাড়বে কীটপতঙ্গের উপদ্রবও। যা প্রভাব ফেলতে পারে ফসলের উৎপাদনেও।
গত ৩০-৪০ বছরে মাঝেমধ্যেই বর্ষা কেন এমন আচরণ করছে, তার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য কোমর বেঁধে নেমেছেন আবহবিজ্ঞানীরা। প্রশান্ত মহাসাগরের ‘এল নিনো’ বা দুষ্টু ছেলের উপরে দায় চাপাচ্ছেন অনেকে। অনেকে বলছেন, নগরায়ণ ও বাতাসে অত্যধিক কার্বনকণার জন্যই ভারতীয় উপমহাদেশের জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এতে বর্ষা ক্রমেই রহস্যময়ী হয়ে উঠছে। |