আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তার পরে শুরু হয়ে যাবে ‘ফাইনাল কাউন্টডাউন।’
নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি তাই উৎয় ভরপুর। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে তাদের নতুন মঙ্গলযান কিউরিওসিটি। আজ, সোমবার ভারতীয় সময় বেলা এগারোটা নাগাদ সে লাল গ্রহে পা রাখতে চলেছে।
কী এই কিউরিওসিটি?
মঙ্গল গ্রহ অভিযানে পাঠানো নাসার সর্বাধুনিক যান (রোভার, অর্থাৎ যা অন্য গ্রহের মাটিতে নেমে চলতে পারে।) দেখতে অনেকটা মাকড়সার মতো। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি আদতে একটা চলমান গবেষণাগার। মঙ্গলের মাটিতে নামার পর থেকে যার মূল কাজ হবে রক্তিম গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজা।
অ্যাটলাস ভি ৫৪১ মহাকাশযানে সওয়ার হয়ে ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর কিওরিওসিটি পাড়ি জমিয়েছিল মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে। নাসা জানিয়েছে, দীর্ঘ মহাকাশপথ উজিয়ে শনিবার রাতে সে যাত্রার শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। অন্তিম ‘ল্যাপ’-এ তাকে আর ‘মাত্র’ ৩০ লক্ষ কিলোমিটার অতিক্রম করতে হবে। শেষ ‘ল্যাপ’ পেরোতে তার খুব বেশি ঝঞ্ঝাট পোহাতে হবে না বলেই নাসার প্রযুক্তিবিদদের আশা। শনিবার রাতে ওঁরা জানিয়েছিলেন, এই সময়টায় মঙ্গল গ্রহের আবহাওয়া শান্ত থাকে। অবতরণের জন্য যা জরুরি।
তবে তাঁরা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। পরিস্থিতি ঠিকঠাক আছে কি না জানতে নিরন্তর যোগাযোগ রাখা হচ্ছে মঙ্গলযানের কম্পিউটারের সঙ্গে। কিউরিওসিটি যত মঙ্গলের দিকে এগিয়ে চলেছে, পাল্লা দিয়েও বাড়ছে বিজ্ঞানীদের উৎকণ্ঠা। তাঁদের বক্তব্য, আজ মঙ্গলের পরিমণ্ডলে ঢোকার দু’ঘণ্টা আগে নাসার গবেষণাগার থেকে শেষ বারের জন্য বার্তা যাবে কিউরিওসিটিতে। যার মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দেওয়া হবে, মহাকাশে তার অবস্থান ঠিক কোথায়।
আর তার পর থেকে শুধুই পর্যবেক্ষণের পালা। যা চলবে কিউরিওসিটি মঙ্গলের মাটি ছোঁয়া পর্যন্ত। অবতরণের কয়েক মিনিটের মধ্যে খবরটি নাসা পেয়ে যাবে, মঙ্গলের কক্ষপথে টহলদার উপগ্রহ মারফত। নির্বিঘ্ন অবতরণের সেই ‘সুসংবাদ’ না-আসা ইস্তক উদ্বেগের অবসান হবে না। নাসার মঙ্গল অভিযান প্রোগ্রামের ডিরেক্টর ডাগ ম্যাককুইসনের কথায়, “এর আগে কোনও অবতরণ এতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল না।” |
কিন্তু আগেও তো দু’-দু’বার লাল গ্রহে অভিযাত্রী গাড়ি (রোভার) নেমেছে! এ বারের বিশেষত্ব কী?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই চলমান গবেষণাগারটি (কিউরিওসিটি) অনেক বেশি আধুনিক। উপরন্তু এটি আগের দু’টোর তুলনায় বিস্তর ভারী, আকারেও বড়। যানটির ভিতরে রয়েছে রাসায়নিক ও ভূতাত্ত্বিক পরীক্ষার নানা সরঞ্জাম। পাশাপাশি মঙ্গলের মাটি-পাথরের নমুনা বিশ্লেষণ করে ফলাফল সরাসরি পৃথিবীতে পাঠানোর বন্দোবস্ত। ছকে বাঁধা সময়ের মধ্যে পুরো ‘দায়িত্ব’ যাতে সুষ্ঠু ভাবে সম্পাদিত হতে পারে, কিউরিওসিটির কম্পিউটার-মগজে তার জন্য ঠাসা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রোগ্রাম। তেজস্ক্রিয় জ্বালানি থেকে শক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থাও মজুত।
এত রকম আয়োজনের সুবাদেই ঝুঁকি বেশি। সতর্কতা আরও বেশি। কী রকম?
নাসা জানিয়েছে, মঙ্গল গ্রহের পরিমণ্ডলে প্রবেশের ঠিক আগের মুহূর্তে অ্যাটলাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কিউরিওসিটি। মঙ্গলের মাটি পর্যন্ত তার বাহন হবে একটি উড়ন্ত চাকতি, যা সেকেন্ডে ৬ কিলোমিটার গতিবেগে লাল গ্রহের পরিমণ্ডলে ঢুকবে। সৃষ্টি হবে ঘর্ষণজনিত প্রচণ্ড তাপ। এতে কিউরিওসিটির যাতে কোনও ক্ষতি না-হয়, সে জন্য চাকতি-যানে তাপনিরোধক বিশেষ ঢাল রয়েছে। গন্তব্যের কাছাকাছি এলে চাকতির গতি কমবে ধীরে ধীরে। মঙ্গলপৃষ্ঠের ১১ কিলোমিটার উচ্চতায় চাকতির পিছন দিক দিয়ে একটা পেল্লায় প্যারাস্যুট বেরিয়ে আসবে, যাতে ভর করে চাকতি নামতে থাকবে। অবশ্য পূর্ণ অবতরণের জন্য এটাও যথেষ্ট নয়। মঙ্গলের মাটির প্রায় কাছাকাছি এসে প্যারাস্যুট আলাদা হয়ে যাবে। কিন্তু এর ফলে চাকতি ধপ করে পড়ে যাবে না, কারণ পরমুহূর্তে ছোট-ছোট আটটা ঊর্ধ্বমুখী রকেট চালু হয়ে তাকে ঠেলতে থাকবে উপরে।
এক দিকে মঙ্গলের নিম্নাভিমুখী মাধ্যাকর্ষণ, অন্য দিকে আট রকেটের সম্মিলিত উর্ধ্বটান দু’য়ের ‘দ্বৈরথে’ চাকতি-যান মঙ্গলপৃষ্ঠের কুড়ি ফুট উপরে এসে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিশ্চল হয়ে পড়বে। তখনই শুরু হবে কিউরিওসিটির অবতরণপর্ব। কেমন হবে সেটা?
নাসা জানিয়েছে, চাকতি থেকে একটা ঝুলন্ত ক্রেন কিউরিওসিটিকে ধীরে ধীরে মঙ্গলের মাটিকে নামাবে। সে মাটি ছোঁয়া মাত্র চাকতিটি সামান্য কাত হয়ে উপরে উড়ে যাবে। উদ্বেগের প্রহর ফুরোবে তখনই।
নাসা-সূত্রের খবর: অবতরণের সময়ে ধুলোর ঝড়ে যাতে কিউরিওসিটির গবেষণাগারের কোনও ক্ষতি না হয়, সেটা মাথায় রেখেই এত সতর্কতা। বস্তুত কিউরিওসিটিবাহী চাকতি-যানের মঙ্গল-পরিমণ্ডলে প্রবেশ থেকে শুরু করে গ্রহের মাটি স্পর্শ পুরো ঘটনাটা ঘটবে সাত মিনিটে। ওই সাত মিনিটই অভিযানটির চূড়ান্ত পর্ব। ফাইনাল কাউন্টডাউন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই সাত মিনিটে ভুলের কোনও জায়গা নেই। তখনকার সামান্য ত্রুটিই পণ্ড করে দিতে পারে এত দিনের পরিশ্রমকে। নাসার বিজ্ঞানীদের কথায় ‘সাত মিনিটের আতঙ্ক।’
এই ‘আতঙ্কের পথ’ পেরোতে নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে এখন যুদ্ধকালীন তৎপরতা। যার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে এক বঙ্গতনয়া নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবের সিনিয়র সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ার অনিতা সেনগুপ্ত। কিউরিওসিটিকে মঙ্গলের মাটিতে নামানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞদের অন্যতম এই প্রযুক্তিবিদ লক্ষ্যপূরণের আগের মুহূর্তে দু’চোখের পাতা এক করতে পারছেন না।
‘আতঙ্ক’ উতরে কিউরিওসিটি কী ভাবে লাল গ্রহে পা ফেলে, সেটাই দেখার। |