আড়াই বছরের বাচ্চা মেয়েটার খেলতে খেলতে ঘরের দরজায় হাত আটকে গিয়ে একটা আঙুলই দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল!
সেই হাতই অলিম্পিক পদক এনে দিল ভারতকে!
মা ঊষা ঘরের মেঝে থেকে কাটা আঙুল তুলে সাইনাকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটে গেলে তিরিশটা সেলাই করে আঙুল জোড়া লাগে।
সেই হাতই ইতিহাস রচনা করল ব্যাডমিন্টনে ভারতকে প্রথম অলিম্পিক পদক এনে দিয়ে। |
পদক জয়ের পর। ছবি: উৎপল সরকার |
সাইনা নেহওয়ালের ব্রোঞ্জ জয়কে অলিম্পিকের ‘অলৌকিক পদক জয়’ বলা হচ্ছে। ওয়েম্বলি পার্কে দুই পরাজিত সেমিফাইনালিস্টের লড়াইয়ে শনিবার প্রথম গেম হেরে এবং দ্বিতীয় গেমেও পিছিয়ে থেকেও সাইনা ম্যাচ জিতে গেলেন প্রতিদ্বন্দ্বী চিনের জিন ওয়াং হাঁটুর চোটের জন্য আর খেলতে না পারায়। সাইনা তখন ১৮-২০, ০-১ পিছিয়ে। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে দু’নম্বর ওয়াং সাইডলাইনে অনেকক্ষণ সময় ধরে ডাক্তার এবং সাপোর্ট স্টাফের শুশ্রূষা নিয়েও সহজ ভাবে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিলেন না। রেফারির দিকে তাকিয়ে হাত তুলে ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত করতেই প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে সহমর্মিতার হাত প্রথম বাড়িয়ে দেন সাইনা-ই। ওয়াংকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেন হায়দরাবাদের বাইশ বছরের তরুণী। মাত্র দ্বিতীয় ভারতীয় মেয়ে হিসেবে অলিম্পিক পদক জেতার (২০০০ সিডনি অলিম্পিকে ভারোত্তোলনে কর্ণম মালেশ্বরীর ব্রোঞ্জ পদক জেতার পর) বিরল নজির গড়েও সাইনাকে সামান্যতম উৎসব করতেও দেখা যায়নি। সাইনার এই অসাধারণ খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব তাঁর অলিম্পিক পদক জয়ের সমানই প্রচণ্ড প্রশংসিত হচ্ছে দেশ জুড়ে সোশ্যাল নেটওয়াকির্ং সাইটগুলোতে। |
অনেক পরে বিজয়মঞ্চে গলায় ব্রোঞ্জ পদক ঝুলিয়ে সাইনাকে হাসতে দেখা যায়। হাত তুলে অভিনন্দন গ্রহণ করেন তাঁর প্রিয় গোপী স্যার (কোচ গোপীচন্দ)-সহ বিশাল ভারতীয় শিবিরের। কিন্তু তখনও যেন সাইনার ঘোর কাটেনি এ ভাবে প্রায় হারা ম্যাচ থেকে ঐতিহাসিক অলিম্পিক পদক জেতার। “আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে, অলিম্পিক পদক জিতেছি। ব্যাডমিন্টনে ভারত কোনও দিন অলিম্পিক পদক জিতবে বলে আমি বিশ্বাস করিনি। কারণ এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এত অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন! কিন্তু আজ আমারই গলায় অলিম্পিক পদক। এর চেয়ে বড় স্বপ্ন পূরণ হওয়া আমার জীবনে সম্ভব ছিল না,” বলেছেন সাইনা।
ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের মুখ যাঁকে ভাবা হয়, সেই প্রকাশ পাড়ুকোনের উচ্ছ্বসিত মন্তব্য, “১৯৮০-তে আমি যখন অল ইংল্যান্ড জিতেছিলাম, সেটা ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে বিপ্লব এনে সেটা নতুন করে প্রচারের আলোয় এসেছিল। আজ বত্রিশ বছর পরে সাইনা ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে দ্বিতীয় বিপ্লব ঘটাল। কোনও ভারতীয় মেয়ে অলিম্পিকে কোনও ব্যক্তিগত ইভেন্টে পদক জিতছে, এটা আমাদের সময় ভাবা যেত না। সাইনা সেই অবিশ্বাস্যকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে বাবা-মা’রা মেয়েকে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলোতেও উৎসাহ দেবে। এই পদক দেশে ব্যাডমিন্টনের ছবিটাই বদলে দেবে।” |
হরিয়ানার হিসার-এ জন্ম সাইনার। পদক জেতার এক ঘণ্টার মধ্যে হরিয়ানা সরকার তাঁকে এক কোটি টাকা পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। দিল্লির রোবট প্রস্তুতকারী কোম্পানি সাইনার নামে একটি নতুন রোবট তৈরি করার কথা জানিয়ে দেয়।
প্রতিদ্বন্দ্বীর ওয়াকওভারের সুবাদে তাঁর অলিম্পিক পদক লাভ, তা সত্ত্বেও সাইনা বলেছেন, “আমি প্রচণ্ড কঠিন ট্রেনিং করেছিলাম। গতকালের সেমিফাইনাল ম্যাচের হার আমাকে এখনও ধাক্কা মারছে। কিন্তু অলিম্পিক পদক হল অলিম্পিক পদক। তার কী রং সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে আমি এ ভাবে কোনও ম্যাচ আগে জিতিনি। ঈশ্বর হয়তো আমার নামে অলিম্পিক পদক লিখে রেখেছিলেন।”
এ দিনও অবশ্য চিনা প্রতিপক্ষের গতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন সাইনা। প্রথম গেমে ১৪-২০-তে পিছিয়ে পড়ার পর সাইনা যেন প্রথম বার নিজের ফর্মে ফিরছিলেন। টানা চারটে গেম পয়েন্ট বাঁচিয়ে ১৮-২০ করেন। এই সময় ওয়াং প্রথম গেম জেতার মরিয়া তাগিদে অনেকটা লাফিয়ে স্ম্যাশ করতে গিয়ে শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে কোর্টের মেঝেতে পড়ে যান। বাঁ হাঁটুর ওপর শরীরের প্রায় পুরো ওজনটা গিয়ে পড়ে তাঁর। উঠতে গিয়ে দেখেন দাঁড়াতেই পারছেন না। তবে কোর্টের বাইরে গিয়ে শুশ্রূষা করিয়ে আবার ফিরে এসে আক্রমণাত্মক শটেই ২১-১৮-এ প্রথম গেম জেতেন। দ্বিতীয় গেমও শুরু করেন এবং প্রথম পয়েন্টটাও জেতেন। কিন্তু তার পরে ওয়াংয়ের পক্ষে আর ম্যাচ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পরে সাইনা বলেন, “আমি প্রথমে ভেবেছিলাম কোর্টে পড়ে যাওয়ায় ওয়াং একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। তার পর বুঝতে পারলাম, ও চোট পেয়েছে। কিন্তু এ রকম একটা ম্যাচ ছেড়ে দেবে ভাবতে পারিনি। ওয়াংয়ের জন্য খারাপ লাগছে। তবে আমি ওকে শেষ পর্যন্ত হারানোর ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। প্রথম গেমের শেষের দিকে নিজের ছন্দে ফিরে এসেছিলাম।” |
‘অসাধারণ। মাত্র দ্বিতীয় ভারতীয় মেয়ে হিসেবে সাইনা অলিম্পিক পদক জিতেছে। অবিস্মরণীয় কীর্তি।’
সচিন তেন্ডুলকর |
‘গোপী আমাকে বলেছিল, সাইনার মতো পরিশ্রম করতে ও কাউকে দেখেনি। বাকিটা আজ ইতিহাস।’
মহেশ ভূপতি |
|
অলৌকিক ভাবে অলিম্পিক পদক জিতেছেন তিনি, বোঝামাত্র সাইনা সাইডলাইনে বসা গোপীচন্দের দিকে তাকান। হাত নাড়েন।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতিহাস গড়লেও সাইনা যে খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব হারাননি। অলৌকিক হলেও তাই সাইনার অলিম্পিক পদক চিরস্মরণীয়!
|
দেশ |
|
|
|
মোট |
চিন |
২৫ |
১৬ |
১১ |
৫২ |
যুক্তরাষ্ট্র |
২৫ |
১১ |
১৪ |
৫০ |
ব্রিটেন |
১১ |
৭ |
৮ |
২৬ |
দক্ষিণ কোরিয়া |
৯ |
৩ |
৫ |
১৭ |
ফ্রান্স |
৮ |
৬ |
৮ |
২২ |
ভারত (৩৭ তম) |
০ |
১ |
২ |
৩ |
অষ্টম দিন রাত দু’টো পর্যন্ত |
|