৩ বছরে ৩, গ্র্যান্ড স্ল্যামের শৃঙ্গে বাঙালি
কৃষ্ণনগরের খ্যাতি, এত দিন জানা ছিল, সরভাজা আর মাটির পুতুল। তালিকায় নতুন সংযোজন: পর্বতারোহণ।
আলোকপ্রাপ্ত কলকাতা নয়। পাহাড় অধ্যুষিত উত্তরবঙ্গ নয়। এমনকী লাল টিলার পুরুলিয়াও নয়। সমতলের পলিমাটিতে দাঁড়ানো এক জেলাসদরে তৈরি হচ্ছে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী নতুন বাঙালি।
নদীমাতৃক বঙ্গদেশের ছেলেরা একদা বিশাল নৌকো নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে সুবর্ণদ্বীপ-যবদ্বীপে চলে গিয়েছেন, হেলায় লঙ্কাজয় করেছেন! সেই বাঙালি এখন শুধুই বিক্ষোভ, মিটিং-মিছিল আর আন্দোলনে ব্যস্ত। তারই মাঝে পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার, পায়ে ক্রাম্পন লাগানো বুট, হাতে আইস-অ্যাক্স নিয়ে দুই পর্বতারোহীর দৌলতে কৃষ্ণনগরের খ্যাতি অধুনা বাঙালি জনসমাজে আশ্চর্য এক প্রহেলিকা!
সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল ২৬ বছর আগে। ‘দেশ’ পত্রিকায় সে বার কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সন্দাকফু-ভ্রমণ প্রকাশিত হয়েছিল। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা অশোক রায় সেটি পড়ে ভাবলেন, জায়গাটায় গেলে হয় না? সুভাষ মুখোপাধ্যায় পড়ার পর বাঙালি ছেলে কবিতা লিখবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অশোকবাবু চলে গেলেন পাহাড়ে।
এই অভ্যাসের সাহসেই হেলায় শিখর জয়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
আর পাঁচ জন বাঙালির মতো অশোকবাবুরও বেড়ানোর শখ আছে। তবে দিল্লি, আগরা ইত্যাদি। পাহাড় এই প্রথম। জামা, জুতো সবই অন্যের থেকে ধার করা। চড়াই বেয়ে উঠতে উঠতে প্রবল বৃষ্টি। স্থানীয় এক কাঠের বাড়ির দাওয়ায় আশ্রয় নিয়ে ছুরপিতে (ইয়াকের দুধ থেকে তৈরি এক রকমের শক্ত কটেজ চিজ) কামড় বসিয়ে অশোকবাবুই বন্ধুকে প্রথম কথাটা পাড়লেন, “হ্যাঁ রে, আমরা তো আরও ভাল প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পারতাম। একটা ক্লাব করা যায় না?”
আশির দশকের কৃষ্ণনগর। সিপিএম, কংগ্রেস আছে। ছড়িয়ে আছে নকশালরাও। কিন্তু সরকারি কর্মচারী অশোকবাবুর অদ্ভুত খেয়াল। কোঅর্ডিনেশন কমিটি বা সিটু করা নয়, বরং পাহাড়হীন কৃষ্ণনগরে মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব তৈরি। “ছেলেবেলায় নকশাল-অধ্যুষিত শক্তিনগর এলাকায় থাকতাম। অনেক রক্তারক্তি দেখেছি। তাই শুরু থেকেই রাজনীতিকে এড়িয়ে গিয়েছি,” বলছেন তিনি।
‘মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন অফ কৃষ্ণনগর’ বা ‘ম্যাক’-এর সূত্রপাত হয়েছিল এই ভাবেই। আজ সেই ক্লাবে প্রায় ৫০ জন সদস্য। “লাল, সবুজ সব রং-ই পাবেন! কিন্তু আমরা সবাই অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী,” বলছিলেন অশোকবাবু।
শুরুতে অবশ্য ৫০ জন সদস্য ছিল না, ছিল না নিজস্ব বাড়িও। তখন মেরেকেটে সাত-আট জন, এক-এক সপ্তাহে এক-এক জনের বাড়িতে বৈঠক বসত। “অনেকেই এসেছিল। কিন্তু যখন দেখল, ক্লাব মানে এখানে ক্যারম খেলা হয় না! দুর্গাপুজো-কালীপুজো-পিকনিক নেই! নিজেরাই আস্তে আস্তে ব্যাঙাচির লেজের মতো খসে গেল,” বলছিলেন এক সদস্য।
১৯৮৬ সালে ক্লাব তৈরি হল, পরের বছরই সেখানে যোগ দিলেন ব্যাঙ্কে সদ্য চাকরি-পাওয়া তরুণ, বসন্ত সিংহরায়। কয়েক বছর পরে এক কলেজপড়ুয়া দেবাশিস বিশ্বাস। খর্বকায়, গড়পড়তা চেহারা। কিন্তু বসন্ত ইতিমধ্যেই সন্দাকফু, ফালুট ঘুরে এসেছেন। দেবাশিস ঘুরে এসেছেন সিকিমের জোংরি পাহাড়ে। দু’জনের পাহাড়প্রেম যতটা, আত্মবিশ্বাসও প্রায় ততটাই।
ক্লাব তখন বছরে এক বার ‘রক ক্লাইম্বিং কোর্স’ করায়। কিন্তু সদস্যদের স্বপ্ন আরও বড়। পাহাড় চড়া শিখতে অশোকবাবু এক দিন চলে গেলেন পহেলগামের মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে। বসন্ত-দেবাশিস গেলেন উত্তরকাশীর নেহরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং-এ। “প্রশাসনিক পরিকাঠামো দার্জিলিঙের তুলনায় ভাল। ওখানে আধুনিক কলাকৌশল আর একটু ভাল রপ্ত করা যায়,” বলছেন বসন্ত।
উত্তরকাশীর স্কুলেই শেখা গেল, বরফের উপর দিয়ে কী ভাবে উঠতে হয়! কী ভাবে তাঁবু খাটানোর জায়গা বাছতে হয়। অতঃপর অফিসে ছুটিছাটার সুযোগে বসন্ত-দেবাশিসরা চলে গেলেন গঢ়বাল হিমাচলের ছোট ছোট পাহাড়ে। তবে আলাদা আলাদা ভাবে। বাংলার পর্বতারোহণের ‘লি-হেশ’ তখনও একসঙ্গে প্র্যাকটিস করেন না।
জুটিটা তৈরি হল ক্লাবের দশম বর্ষে, ১৯৯৬ সালে। ঠিক হল যাওয়া হবে ৭৭৫৬ মিটার উঁচু কামেট শিখরে। নন্দাদেবীর পরেই গঢ়বালের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ। পর্বত অভিযান অবশ্য শুধু ক্লাবে বসে পরিকল্পনা করলেই হয় না। দিল্লিতে ফেডারেশনের থেকে অনুমতি লাগে, শেরপা ঠিক করতে হয়। হ্যাপা সামলানোই প্রায় পাঁচ-সাত মাসের ধাক্কা।
এভারেস্টের দুর্গম পথে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
হ্যাপা তো না হয় সামলানো গেল, কিন্তু অ্যাডভান্সড ক্যাম্প থেকে শিখরে যাওয়ার পথে টানা তিন দিনের তুষারঝড়। শেরপা এবং অভিযাত্রীরা কোনও ক্রমে নীচে নেমে পালিয়ে বাঁচলেন। কিন্তু তাঁবু-দড়ি-জুমার, অন্যান্য যন্ত্রপাতি উপরেই থেকে গেল। মফস্সলের ক্লাবটির তখনও নিজস্ব সরঞ্জাম ছিল না, সবই উত্তরকাশীর ইনস্টিটিউট থেকে ভাড়া করা। মফস্সলের বাঙালিকে কে আর বিশ্বাস করে? ইনস্টিটিউটে তুমুল অপমানের মুখোমুখি দাঁড়াতে হল কৃষ্ণনগরকে। ক্লাবে ফিরে ঠিক করা হল, পরের মরসুমে লক্ষ্য ফের কামেট! এ বার এল সাফল্য। এমনকী আগের বার ফেলে-আসা যন্ত্রপাতিগুলিও অক্ষত অবস্থায় উপর থেকে নামিয়ে আনা গেল। “উত্তরকাশীর লোকেরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঘটনাটা আমাদের দারুণ আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল,” বলছেন বসন্ত।
পরের আট বছর ঘরবন্দি। ২০০৫ সালে যাওয়া হল ২২ হাজার ফুট শিবলিঙ্গ। ‘উইকিপিডিয়া’য় আজও জ্বলজ্বল করছে তথ্যটা: ‘সে বছর পশ্চিমবঙ্গের বসন্ত সিংহরায় ও দেবাশিস বিশ্বাস এই শিখর জয় করেছিলেন। প্রথম শিবলিঙ্গজয়ী ভারতীয় অভিযাত্রী, যাঁদের সেনাবাহিনীর সাহায্য লাগেনি।’
তিন বছর পরে, ২০০৮ সালে ৬৮৪০ মিটার উঁচু থলয়সাগর। ৮০০০ মিটারের কম, তাই এই পাহাড়ের ‘গ্র্যান্ড স্ল্যাম’ মর্যাদা নেই। গ্ল্যামারে এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘার ধারেকাছে আসে না। কিন্তু পাহাড়টা খাড়াই ভঙ্গিতে সোজা উঠে গিয়েছে, শিখরে পৌঁছনো প্রায় দুঃসাধ্য। কৃষ্ণনগরের বসন্ত সিংহরায়-ই ওই শিখরে পা-রাখা প্রথম ভারতীয়।
ভারতীয় পর্বতারোহণ-সার্কিটে তখন থেকেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কৃষ্ণনগর। কামেট জয়ের পরই ক্লাবের বাড়ি তৈরির অনুদান পাওয়া গিয়েছিল স্থানীয় সাংসদের অর্থানুকূল্যে। এ বার উদ্বোধন করা হল কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের পাশে ক্লাবের নতুন তিনতলা বাড়ি। উদ্বোধন করতে এলেন দু’বারের এভারেস্টজয়ী নোয়াং গোম্বু।
শিবলিঙ্গ, থলয়সাগরের পর ভারতীয় হিমালয়-সার্কিটে বসন্তরা তখন প্রায় তারকা। কিন্তু এই নক্ষত্রদ্যুতি তো ঘরের মাঠে। টলিউডে প্রসেনজিৎ হওয়ার মতো। এই নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে বলিউডে পারফরম্যান্স দেখানো যায় না? ঝুঁকির ব্যাপার, কিন্তু সেটাই তো হবে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ! থলয়সাগরে বসন্ত একাই উঠেছিলেন। সহসা পিতৃবিয়োগ হওয়ায় যেতে পারেননি দেবাশিস। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের জন্য তাঁর মনও তো উচাটন। ভারতীয় হিমালয়ে আর কতদিন? যাওয়া যায় না অন্য কোথাও? গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিখরগুলিতে?
লক্ষ্য যখন কাঞ্চনজঙ্ঘা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
শেরপাদের সঙ্গে আলোচনায় জানা গেল, কাঠমান্ডুতে অনেক ক্লাইম্বিং এজেন্সি রয়েছে। টাকা দিলে তারাই এভারেস্ট নিয়ে যায়। রসদ-টসদও তাদের দায়িত্ব। খবর নিয়ে দেখা গেল, এক-এক জনের গড়পড়তা খরচ প্রায় কুড়ি হাজার ডলার। বাড়িতে দেবাশিসের ছটফটে ভাব দেখে স্ত্রীও এগিয়ে এসেছেন। “দরকারে আমার গয়না বন্ধক দিয়েও তুমি ইচ্ছে পূরণ করো।”
ঘটনাচক্রে সে বারই ম্যাক-এর ২৫ বছর। ঠিক হল, ক্লাবও অভিযানের দায়িত্ব নেবে। পুরোটাই দেবাশিসের পকেটে টান পড়তে দেওয়া যাবে না। পরিকল্পনার ছক কষায় এগিয়ে এলেন দেবাশিসের ক্লাইম্বিং পার্টনার বসন্ত। দেখা গেল, শিখরে ওঠার সদস্য কমালেই খরচ অনেকটা নেমে যাবে। অতএব বসন্তর পরিকল্পনা, শিখরে পাঁচ-সাত জনের টিম নয়। উঠবেন শুধু দেবাশিস ও তিনি। বাকিরা থেকে যাবেন বেসক্যাম্পে। “বসন্ত পরিকল্পনাটা খুব ডিটেলে করে। আর খুব ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রতিটি অভিযানে ও-ই আমাদের নেতা,” বলছিলেন অশোকবাবু। তিনি নিজেও এভারেস্ট অভিযানে সামিল ছিলেন। কিন্তু দলনেতার কথা মেনে বেসক্যাম্প থেকে এগোননি।
কিন্তু শুধু দু’জন উপরে উঠলেও এভারেস্ট অভিযানের বাজেট দাঁড়াল প্রায় ৪০ লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার দফায় দফায় দিল ১৫ লাখ। বসন্ত ব্যাঙ্কে চাকরি করেন, দেবাশিস আয়কর দফতরে। তাঁদের সহকর্মীরাও অভিযানের জন্য তাঁদের হাতে চার লাখ টাকার চাঁদা তুলে দিলেন। “কয়েকটি কোম্পানির কাছেও গিয়েছিলাম। তাঁরা বলে দিলেন, তোমরা বেড়াতে যাচ্ছ, আমরা টাকা দেব কেন? আমাদের এখানে অ্যাডভেঞ্চার-স্পোর্টস নিয়ে মনোভাব এ রকমই,” দুঃখ করছিলেন দেবাশিস। কিছু ধার-বাকি ছিল। সঙ্গী শেরপারা আশ্বস্ত করলেন, পরে দিলেও চলবে।
কিন্তু ২৯,০২৮ ফুট উঁচু দুনিয়ার উচ্চতম শিখরজয় শুধু পরিকল্পনা আর সহমর্মিতায় হয় না। ভাগ্যও লাগে! বসন্ত, দেবাশিসদের প্রথমে চিনের দিকে, নর্থ কল দিয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে চিন অনুমতি দেয়নি। দেবাশিস ভারত সরকারের কর্মচারী যে! অতএব কাঠমান্ডুতে বসেই নতুন পরিকল্পনা করে যাওয়া হল নেপালের দিকে ‘সাউথ কল’ দিয়ে। “এখন মনে হয়, ভালই হয়েছিল। হাওয়ার দাপটে নর্থ কলের বেশির ভাগ অভিযান সে বার সফল হয়নি,” বলছিলেন বসন্ত।
‘ম্যাক’-এর দফতর। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
হাওয়ার দাপট দক্ষিণ গিরিশিরাতেই বা কম কী? খুম্বু হিমবাহ এই পথের অন্যতম বিপজ্জনক এলাকা। রাতে মাইনাস তিরিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সব সময় দশ-বারো তলা বাড়ির মতো বরফের চাঙড় ভেঙে পড়ে। অগত্যা জুতোর নীচে লাগানো ক্রাম্পন (বরফ এবং খাড়াই পাথুরে দেওয়াল বেয়ে ওঠার মতো কাঁটা) মারতে মারতে দড়ি বেয়ে উঠছেন বিভিন্ন দলের অভিযাত্রীরা। সামনে বরফের গহ্বর। শেরপারা বুদ্ধি দিলেন, “আর এগিও না। অপেক্ষা করো। অন্য দলগুলো এগিয়ে গেলে তাদের পায়ের ছাপ ধরে এগিও।”
পাহাড়ে অপেক্ষা করা মানে অবশ্য, ‘ফিক্সড রোপ’ ধরে ঝোলা। “কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতা, টানা দশ বছর ট্রেনে বাদুড়ঝোলা হয়ে যে ভাবে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করেছি, ওই রাতে সেটা বেশ কাজ দিয়েছিল,” বলছেন দেবাশিস।
দুনিয়ার উচ্চতম শিখরের ‘গ্র্যান্ড স্ল্যাম’ জিতে এলেন কৃষ্ণনাগরিক দুই তরুণ। ১৭ মে, ২০১০। বঙ্গভাষী সার্ভেয়ার রাধানাথ শিকদারের মাপা পর্বতশৃঙ্গে প্রথম ছাপোষা, ‘সিভিলিয়ান’ বঙ্গভাষীর জয়পতাকা।
অন্য বাঙালি হলে হয়তো গল্পটা এখানেই থেমে যেত। এভারেস্টে পা রাখার পর আর নতুন কীই বা করা যায়? দরকারই বা কী? বাকি জীবনটা স্মৃতি রোমন্থন, পাড়ার পুজো উদ্বোধনে বিশেষ অতিথি আর ঝোপ বুঝে একখানা বঙ্গভূষণ, এর বেশি বাঙালি আর কী চায়?
কিন্তু কৃষ্ণনগরে বসে যাঁরা গ্র্যান্ড স্ল্যামের স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা তো সাধারণ বাঙালি নন।
অতএব, উইম্বলডনের পরে ফরাসি ওপেন। তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘায় প্রায় দিন ষাটেকের অভিযান।
শিখরে পৌঁছনোর ঠিক আগে, সামিট ক্যাম্পই এখানে ৭৫০০ মিটারের উপর। সেখানে কয়েক ঘণ্টার বেশি কেউ থাকে না। দুপুরে পৌঁছে রাতে শিখরের দিকে এগোতে হয়। কিন্তু এখানেই দু’রাত আটকে পড়তে হল। উপগ্রহ-চিত্র দেখে নীচ থেকে স্যাটেলাইট ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, “আবহাওয়া খারাপ। শিখরে যাওয়ার ঝুঁকি নিও না।”
৪৮ ঘণ্টা পরে সামিট ক্যাম্প থেকে বসন্ত-দেবাশিস এগোতে থাকলেন শিখরের দিকে। জলের স্টক ততক্ষণে প্রায় শেষ। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে! শক্ত বরফ ভেঙে দু’জনে জিভে ঘষছেন, তাতেও পিপাসা মিটছে না। এতটুকু বসার উপায় নেই। তৃষ্ণার্ত অবস্থাতেই বরফের দেওয়াল বেয়ে হাঁটতে হচ্ছে শিখরের দিকে। এবং সেখান থেকে ফের জল ছাড়াই নেমে আসতে হবে শিবিরে। সব মিলিয়ে প্রায় ২৭ ঘণ্টার ওঠানামা, পুরোটাই জল ছাড়া। “কী ভাবে যে সময়টা কাটিয়েছিলাম, ভাবলেও অবাক লাগে,” বলছেন বসন্ত। এভারেস্ট জয়ের পরের বছর এ ভাবেই তৃষ্ণার্ত বাঙালির ৮০০০ মিটার উঁচু আর এক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়। সে দিন ছিল ২০ মে, ২০১১।
ভিতরে স্বীকৃতির নানা চিহ্ন। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
ক্লাবঘরের সাদা দেওয়ালে শুধু একটা ছবি। পরপর দাঁড়িয়ে এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে...। দেওয়ালের একপাশে ছেঁড়া মাদুর আর শতরঞ্চি গুটিয়ে রাখা। নিরাভরণ মেঝেতে আজও চেয়ার, টেবিল, তক্তপোশ নেই। কৃষ্ণনগরের এক কবির কলমে একদা দেবীর কাছে ভক্তের প্রার্থনা ছিল, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।’ সেই দেবীর নামাঙ্কিত পর্বতশৃঙ্গ পৃথিবীর ১৪টি ‘ডেথ জোন’-এর অন্যতম।
তিন নম্বর অ্যাডভান্সড ক্যাম্পে ওঠার পরে সেই দেবী অন্নপূর্ণাই যেন প্রাণটা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। ক্যাম্পে যাওয়ার পথে তুষারধস এলাকা। বাঙালি ‘লি-হেশ’ দড়ি ধরে উঠতে উঠতে শুনতে পাচ্ছিলেন, ঝড়ের গর্জন। অন্ধকার আকাশ। তার পরই বুনো হাতির মতো সবেগে নেমে এল বারোতলা সমান বরফের চাঙড়। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে বরফের ধোঁয়া উড়িয়ে সে থমকে গেল অদূরেই। মাত্র এক চুলের জন্য বেঁচে গেলেন কৃষ্ণনগরের দুই সন্তান।
হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছনো গেল আরও উপরে ৪ নম্বর শিবিরে। সেখানে তুষারঝড়ে বসন্তদের তাঁবু অটুট থাকল, কিন্তু দু’হাত দূরে পাশের তাঁবুটা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। পরিস্থিতি দেখে তিন জন জাপানি পর্বতারোহী বেসক্যাম্পে ফিরে গেলেন। কিন্তু কৃষ্ণনগরের ছেলেরা দমলেন না। রাত দশটায় আকাশ একটু পরিষ্কার হতেই তাঁরা এগিয়ে চললেন শিখরের দিকে।
পরদিন রাত বারোটা। মোবাইলের শব্দে কৃষ্ণনগরের বাড়িতে ঘুম ভেঙে গেল অশোকবাবুর। ফোনের ও’পারে বসন্ত আর দেবাশিস। শিবিরে ফিরে স্যাটেলাইট ফোনে খবরটা দিচ্ছেন ওঁরা। অন্নপূর্ণা জয় সমাপ্ত।
তারিখটা ছিল ২০ এপ্রিল, ২০১২। কৃষ্ণনগরের সৌজন্যে সে দিনই তৈরি হয়েছিল বাঙালির নতুন হ্যাটট্রিক: পরপর তিন বছরে আট হাজার মিটারের তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম!
অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অশোক রায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
ঘটনাটাকে পুরোপুরি দিকবদল বলেই মনে করছেন সুগত বসু, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। “সব খেলাতেই মফস্সলের ছেলেরা ছাপ ফেলছেন। কারণ, সুযোগসুবিধা ও গণতান্ত্রিকতার প্রসার।” অন্য মাস্টারমশায়রাও বিস্মিত নন। “সব কিছু কলকাতায় হবে কেন?” প্রশ্ন দিল্লিবাসী সমাজবিজ্ঞানী আন্দ্রে বেতে-র। “বড় শহরে অনেক আকর্ষণ আছে। ছোট শহরে সেই সুযোগ নেই। সেখানকার ছেলেরা হয়তো পূর্ণতা খুঁজছে খেলাধুলো, পাহাড়ে চড়ায়।”
স্টেশন থেকে ক্লাবে আসতে আসতে দেখছিলাম, রাস্তায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ছবি-সাঁটা তোরণ। আতুপুতু সব বাঙালি ‘নন্দলাল’দের নিয়ে একদা হাসির গান লিখেছিলেন কৃষ্ণনগরের এই সন্তান। আর সেই শহরে বাঙালির ‘নন্দলাল’ ইমেজ যারা ভাঙল, সেই ‘মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন অফ কৃষ্ণনগর’-এর পরবর্তী স্বপ্ন কী?
কল্পনার কোনও সীমারেখা নেই। বসন্তদের এখন একটাই ইচ্ছে। “নাঙ্গা পর্বত এবং কে২-এর স্বপ্ন অনেক দিন ধরে দেখছি। কিন্তু ওঠার রাস্তাটা পাকিস্তান দিয়ে। এখন তো দুই দেশের মধ্যে ক্রিকেট ফের শুরু হচ্ছে। বাঙালি রাষ্ট্রপতি যদি আমাদের কথাটা ভাবেন!”




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.