রাতে যখন বৃষ্টির বেগ বাড়ছিল, সঙ্গে প্রবল ঝড় এবং বজ্রপাত হচ্ছিল ঘনঘন, উত্তরকাশীর বাসিন্দারা তখনও ঘুণাক্ষরে ভাবতে পারেননি, কী দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে মাথায় ‘আকাশ ভেঙে’ পড়ল তাঁদের। মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে ভেসে গেলেন বহু। যাঁদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত ১০ জনের দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। নিখোঁজ আরও অন্তত ৪০ জন।
প্রবল বৃষ্টি শুধু উত্তরাখণ্ডেই বিপর্যয় নিয়ে আসেনি, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীরও রক্ষা পায়নি তার হাত থেকে। হড়পা বান ডেকেছে হিমাচলের মানালির কাছেও। সেখানে এক জন প্রাণ হারিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে ঘাঘরা নদীর জলে ভেসে গিয়েছে দুই শিশু। বরাবাঁকি-ফৈজাবাদ জেলাতেও কয়েকটি গ্রাম ভেসে গিয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। সব মিলিয়ে উত্তর ভারতে গত ২৪ ঘণ্টার বাঁধ ভাঙা বৃষ্টিতে এখন পর্যন্ত প্রাণ গিয়েছে ১৩ জনের। জম্মুতে বন্যায় আটকে পড়েছেন ২২ জন। সেখানে একাধিক নদীর জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে।
অন্য রাজ্যে যতই ক্ষয়ক্ষতি হোক না কেন, সব থেকে বেশি বিপর্যস্ত কিন্তু উত্তরাখণ্ড। |
মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে ফুঁসছে ভাগীরথী। শনিবার উত্তরকাশীতে। ছবি: পি টি আই |
শুক্রবার রাত এগারোটা নাগাদ উত্তরাখণ্ডের গঙ্গোরি এলাকায় বিপর্যয়ের সূত্রপাত। উত্তরকাশী থেকে গঙ্গোরির দূরত্ব চার কিলোমিটার। আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, সেখানেই ক্লাউডবার্স্ট বা মেঘ ভাঙা বৃষ্টি নেমে আসে শুক্রবার রাতে। তা পরিণত হয় হড়পা বানে। প্রবল বৃষ্টিতে তত ক্ষণে বহু জায়গায় ধস নেমেছে। যে ৪০ জন এখনও নিখোঁজ, তাঁদের মধ্যে আছেন অসিগঙ্গার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে থেকে ভেসে যাওয়া ১৯ জন শ্রমিক। মৃতদের মধ্যে রয়েছে তিনটি শিশু, যাদের মধ্যে দু’জন চামোলি জেলার কর্ণপ্রয়াগে বাড়ি ভেঙে প্রাণ হারিয়েছে। অন্য শিশুটি পোখরি অঞ্চলে জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে।
ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি) সূত্রের খবর, শুক্রবার রাতের দুর্যোগে গোটা উত্তরকাশীই ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়েছে। ঘাঘরা নদীর ধারে প্রায় ৬০টি গ্রাম ভেসে গিয়েছে। ভেঙে পড়েছে সেতু। বিপর্যস্ত রেল-সড়ক যোগাযোগ। বন্ধ হয়ে গিয়েছে কেদার-বদ্রী, গঙ্গোত্রী এবং যমুনোত্রী যাত্রা। বৃষ্টি ও ধসে পথে আটকে পড়েছেন কয়েক হাজার তীর্থযাত্রী। স্কুল-কলেজ-অফিস বন্ধ। খাবার-জল মিলছে না। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত।
আইটিবিপি জানিয়েছে, দুর্গতদের উঁচু এলাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁদের জন্য খাবার এবং জলের বন্দোবস্তও রয়েছে। আইটিবিপি-র জনসংযোগ আধিকারিক দীপককুমার পাণ্ডে বলেন, “শুক্রবার গভীর রাত থেকেই জওয়ানেরা উদ্ধারে নেমেছেন। পরে অতিরিক্ত বাহিনী পাঠানো হয়।” এ পর্যন্ত শ’তিনেক পরিবারকে সরানো হয়েছে বলে জানান তিনি। তীর্থযাত্রীদেরও নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা হচ্ছে। উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরাও উদ্ধারে নেমেছেন। তবে প্রতিকূল পরিস্থিতির জেরে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। নিখোঁজদের জন্য তল্লাশি চলছে বলে জানিয়েছেন উত্তরকাশীর জেলাশাসক আর রাজেশ কুমার। |
পরিস্থিতি এখনও আশঙ্কাজনক বলে জানিয়ে জেলা প্রশাসনের সতর্কবার্তা, বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে ভাগীরথী। কূল ছাপিয়েছে অসিগঙ্গার জলও। উত্তরকাশী শহরের বাসিন্দা জিতেন্দ্র বহুগুণা ফোনে আনন্দবাজারকে বলেন, “জলের তোড়ে আমাদের শহরের ঝুলাপুলও ভেঙে পড়েছে।” শনিবার দিনভর হাল্কা থেকে মাঝারি বৃষ্টির বিরাম নেই। সন্ধ্যায় ফের বৃষ্টি বেড়েছে।
উত্তরপ্রদেশে স্ফীত হয়ে ওঠা সরজু ও ঘাঘরা নদীর পাড়েও আতঙ্কের আবহ। মানালিতে জনজীবন টালমাটাল। বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন (বিআরও) জানিয়েছে, শুক্রবার রাতে মানালি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে, ধুন্ডিতে হড়পা বানে কয়েকটি সেতু ভেঙে পড়ে। রাস্তার ধারে গাড়িতে বসে থাকার সময় জলের তোড়ে ভেসে যান এক ব্যক্তি। পরে ভাঙাচোরা গাড়ির মধ্যে তাঁর দেহ পাওয়া যায়। ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানালি-রোটাং রোড-সহ কয়েকটি রাস্তা। ফলে ওই রাস্তাগুলিতে যান চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন কুলুর ডেপুটি কমিশনার অমিতাভ অবস্তি।
|
মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি |
মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ছোট এলাকায় মুষলধারায় বৃষ্টি। ঘণ্টায় প্রায় ১০০ মিলিমিটার হারে।
সঙ্গে প্রবল হাওয়া, বজ্রপাত। অল্প সময়ে পাহাড়ি নদী উপচে হড়পা বান। |
কেন |
১৫-২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের জলভরা মেঘের স্তর (উল্লম্ব মেঘ) ভেঙেই এই বৃষ্টি হয়।
উল্লম্ব মেঘ সমুদ্র থেকে পাহাড়ের দিকে যায়। জলের ঘনত্ব বাড়লে তা ভেসে থাকতে
পারে না। ঝরে পড়ে বৃষ্টি হয়ে । |
কখন |
উপ-মহাদেশে সাধারণত বর্ষাকালে উল্লম্ব মেঘ তৈরি হয়। তবে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার জেরে
কাশ্মীর বা হিমাচলপ্রদেশে শীতের মুখেও হতে পারে। |
পশ্চিমবঙ্গে? |
উল্লম্ব মেঘ ১৫-২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট হওয়ার মতো পরিস্থিতি থাকলে
উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চলে মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি হতে পারে। |
|
দুঃস্বপ্নের পাঁচ |
৬ অগস্ট, ২০১০
লেহ্ (জম্মু-কাশ্মীর)
মৃত ১০০০ |
১৬ অগস্ট, ২০০৭
ঘানভি (হিমাচল)
মৃত ৫২ |
১৭ অগস্ট, ১৯৯৮
মালপা (উত্তরাখণ্ড)
মৃত ২৫০ |
১৫ অগস্ট, ১৯৯৭
শিমলা (হিমাচল)
মৃত ১১৫ |
২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯০৮
হায়দরাবাদ (অন্ধ্রপ্রদেশ)
মৃত ১৫ হাজার, ৪০ হাজার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত |
|