সে বাঁচতে চেয়েছিল নিজের মতো করে। চেয়েছিল চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, নিজেই বেছে নেবে নিজের জীবনসঙ্গী। কিন্তু এত ‘ঔদ্ধত্য’ সহ্য হয়নি বাবা-মায়ের। অবাধ্য মেয়েকে ‘শাস্তি’ দিতে তাকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তারা। দুই বোন ও এক ভাইয়ের সামনে ১৭ বছরের শাফিলিয়াকে হাত-পা বেঁধে মুখে প্লাস্টিক গুঁজে দমবন্ধ করে মেরে ফেলেই ক্ষান্ত হল না, প্রমাণ লোপাট করতে শাফিলিয়ার দেহ নদীতে ভাসিয়েও দিল তারা। এর প্রায় এক বছর পরে শাফিলিয়ার দেহাংশ উদ্ধার করে লন্ডন পুলিশ। |
ধৃত বাবা ইফতিকার আহমেদ (ডান দিকে)। |
২০০৩ সালে এই ঘটনা ঘটলেও এত দিন প্রমাণের অভাবে শাফিলিয়ার বাবা, ৫২ বছরের ইফতিকার আহমেদ এবং মা, ৪৯ বছরের ফরজানা আহমেদ প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অবশেষে দীর্ঘ ন’বছর পরে শাফিলিয়ার বোন আলিশার সাক্ষ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল ইফতিকার ও ফরজানার।
গত কাল উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের চেস্টার ক্রাউন কোর্টের বিচারক রডরিক ইভানস এই রায় দিতে গিয়ে জানালেন, পাক বংশোদ্ভূত শাফিলিয়া দু’রকম সংস্কৃতির জাঁতাকলে পড়ে ক্রমাগত পিষে যাচ্ছিল। আর এতে উস্কানি দিচ্ছিল শাফিলিয়ার বাবা-মা। ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ডে জন্ম, ওয়ারিংটনে বড় হয়ে ওঠা। অথচ, এ দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে আজন্ম লালিত শাফিলিয়ার পাশে দাঁড়ানোর বদলে তার উপর নিজেদের রক্ষণশীল মত জোর করে চাপিয়ে দিত শাফিলিয়ার বাবা-মা। বিচারক রডরিকের মতে, যা শুধু বাস্তব বোধবুদ্ধিহীনই নয় হিংস্রও।
পাকিস্তানের বাসিন্দা ইফতিকার কাজের সূত্রে ওয়ারিংটনে এসেছিল। প্রথমে ডেনমার্কের এক মহিলাকে বিয়ে
|
মা ফরজানা |
|
শাফিলিয়া। |
করেছিল সে। পার্টিতে যাওয়া, মদ খাওয়া ছিল নিয়মিত ব্যাপার। কিন্তু বাড়ির মেয়েদের বাইরে যাওয়া ছিল ইফতিকারের না-পসন্দ। এই সময়ই ফরজানার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় ইফতিকারের। বড় মেয়ে শাফিলিয়া অবশ্য ছোট থেকেই বাড়ির এই রক্ষণশীল মনোভাব মেনে নিতে পারেনি। আলিশার কথায়, তাই প্রায় সারাক্ষণই শাফিলিয়ার সঙ্গে বাবা-মার খটাখটি লেগে থাকত। মেয়েকে বশে আনতে তার থেকে বয়সে প্রায় দশ বছরের বড় পাকিস্তানের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা এক যুবকের সঙ্গে শাফিলিয়ার বিয়ে ঠিক করে তারা। জানতে পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে সাহায্যের আর্জি জানায় সে। প্রশাসনের সাহায্যে আলাদা বাড়িতে থাকতেও শুরু করে। একটা কাজও জুটিয়ে নেয়। কিন্তু এক দিন স্কুলে যাওয়ার পথে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে আলিশাকে গৃহবন্দি করে রাখে ইফতিকার। মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে তাকে পাকিস্তানে নিয়ে যায় ইফতিকার-ফরজানা। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ব্লিচ খায় শাফিলিয়া। বাধ্য হয়ে তাকে ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে আনে ইফতিকার। কিন্তু এর পর থেকে তার উপর অকথ্য অত্যাচার চলতে থাকে। আদালতে আলিশা জানিয়েছে, ২০০৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর
শাফিলিয়াকে অফিস থেকে জোর করে তুলে নিয়ে আসে ইফতিকার। হাত-পা বেঁধে তাকে মারতে থাকে ইফতিকার। কারণ, ইফতিকারের মনে হয়েছিল, পশ্চিমী পোশাক পরে নিজেদের সংস্কৃতিকে অসম্মান করেছে শাফিলিয়া। ইফতিকারকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ফরজানাও। পঞ্জাবিতে
স্বামীকে বলে, “ঘটনাটা এখনই মিটিয়ে ফেল।”
এর পরে ভাইবোনের সামনেই শাফিলিয়াকে খুন করে ইফতিকাররা। পুলিশ প্রথম থেকেই ইফতিকার ও ফরজানাকে সন্দেহ করলেও প্রমাণের অভাবে তাদের গ্রেফতার করতে পারছিল না। তখন আলিশার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। এত দিন বাবা-মার ভয়ে কিছু বলতে পারেনি সে। কিন্তু ২০১০ সালে বিনা প্রমাণে বাবা-মা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে দেখে সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায় তার। পুলিশের কাছে সব কিছু স্বীকার করে নেয় সে।
প্রসঙ্গত, শুধু গত বছরেই ব্রিটেনে জোর করে বিয়ে দেওয়ার ১৪০০টি ঘটনার কথা জানা গিয়েছে। অভিযুক্তরা অধিকাংশই পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। যারা অর্থ-বিলাসব্যসন-প্রতিপত্তির মোহে পশ্চিমী দেশগুলিতে বসবাস করতে শুরু করেছে। কিন্তু কুসংস্কার আর প্রাগৈতিহাসিক ধ্যানধারণাকে দেশের সংস্কৃতির নাম নিয়ে মনের গোপনে সযত্নে লালন-পালন করে চলেছে। আর মানতে বাধ্য করছে ছেলে-মেয়েদেরও। না মানলে, সম্মান রক্ষার নামে খুন করতেও যে কুছ পরোয়া নেহি। |