মান্ধাতার পুর-ল্যাব
ভেজাল রুখবে কে
খাবারে ভেজাল ও দূষণের সমস্যা থেকে শহরকে মুক্ত করতে বছর চারেক আগে ভেজাল পরীক্ষার আধুনিক ল্যাবরেটরি গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কলকাতা পুরসভা। কেন্দ্রীয় সরকার তার জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু এই ধরনের ল্যাবরেটরি গড়তে যে আয়তনের ঘর প্রয়োজন, তা না পাওয়ায় গোটা প্রকল্পটাই আপাতত বিশ বাঁও জলে।
২০১১-র অগস্টে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অ্যাক্ট’ চালু হওয়ার ফলে খাবারে ভেজাল পরীক্ষার উন্নত মানের ল্যাবরেটরির প্রয়োজনীয়তা অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে এ শহরে। বর্তমান পরিকাঠামোয় খাবারের নমুনায় ভেজাল আছে কি না, তার অনেক পরীক্ষাই করা যাচ্ছে না। পুরসভার সদর দফতর-লাগোয়া পুরসভার অফিসে পুরনো ল্যাবরেটরিতেই নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। অভিযোগ, সম্প্রতি রাস্তা এবং বাজারে বিক্রি হওয়া খোলা খাবারের নমুনা পরীক্ষাও বন্ধ।
সমস্যার কথা মানছেন পুরসভার মেয়র পারিষদ (প্রিভেনশন অফ ফুড অ্যাডাল্টারেশন) পার্থপ্রতিম হাজারি। তাঁর কথায়: “পরিকাঠামোর অভাবেই উন্নত মানের ল্যাবরেটরি গড়া যায়নি। তাই পুরসভার পুরনো ল্যাবরেটরিতেই আপাতত ভেজাল পরীক্ষার কাজ চলছে। তবে, সমস্ত রকম পরীক্ষার জন্য পুরনো ল্যাবরেটরি যথাযথ নয়। পরিকাঠামোর অভাব এবং আইনি জটিলতায় খাবারের নমুনা সংগ্রহেও ভাটা পড়ছে। নতুন আইন অনুযায়ী উন্নত মানের ল্যাব করতেই হবে। তেমন ল্যাবরেটরি গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। ”
কিন্তু রাস্তা বা বাজারে বিক্রি হওয়া খাবারের নমুনা পরীক্ষায় সমস্যা কোথায়?
মেয়র পারিষদ জানালেন, ২০১১ সালে কেন্দ্র নতুন আইন চালুর পরে নির্দেশিকা আসতে সময় লেগেছে। সেই সময়ে পুরনো ‘প্রিভেনশন অফ অ্যাডাল্টারেশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী খাবারের নমুনা পরীক্ষা সম্ভব কি না, তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে।
ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অ্যাক্ট অনুযায়ী, খাবারের নমুনা পরীক্ষার জন্য উন্নতমানের ল্যাবরেটরি নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। এমন ল্যাবরেটরি না থাকলে আইন বলবৎ হওয়ার পরে তা নির্মাণ করতেই হবে। যত দিন আধুনিক মানের ল্যাবরেটরি গড়া না হচ্ছে, তত দিন পুরনো ল্যাবরেটরিতেই নমুনা পরীক্ষা করা যেতে পারে। এ ছাড়াও, এই আইন অনুযায়ী নতুন ল্যাবরেটরিরও কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদিত ‘দ্য ন্যাশনাল অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ড অফ টেস্টিং অ্যান্ড ক্যালিব্রেশন ল্যাবরেটরিস’ (এনএবিএল)-এর ছাড়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক।
এখনকার ল্যাবরেটরিতে খাবারের নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে কী কী অসুবিধা আছে?
পুরসভার সংশ্লিষ্ট দফতরের এক আধিকারিক জানান, পুরসভার এই পুরনো ল্যাবরেটরিতে অনেক খাবারের নমুনাই সঠিক ভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। জানা সম্ভব হচ্ছে না খাবার বা পানীয়ের নমুনায় ‘পেস্টিসাইড’ বা কীটনাশক রয়েছে কি না।
বছর চারেক আগে কেন্দ্রীয় সরকার পুর-কর্তৃপক্ষকে তিন হাজার বর্গফুটের একটি ঘর চিহ্নিত করে সেখানেই আধুনিক মানের নতুন ল্যাবরেটরি নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিল। প্রস্তাব ছিল, এই ল্যাবরেটরির জন্য প্রয়োজনীয় উন্নত মানের যন্ত্র কিনতে কেন্দ্রই অর্থ বরাদ্দ করবে। পুরসভার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক দীপঙ্কর দাস বলেন, “সিদ্ধান্ত হয়েছিল, শহরের কেন্দ্রস্থলে এই ল্যাবরেটরি নির্মাণ করতে হবে, যাতে সকলেই এই ল্যাবরেটরিতে সহজে আসা-যাওয়া করতে পারেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যে আয়তনের ঘরের কথা বলেছিল, সেই সময়ে মধ্য কলকাতায় তেমন ঘর পাওয়া যায়নি। পরবর্তী কালে বেলেঘাটায় এবং কালীঘাটেও ল্যাবরেটরির জন্য জায়গা খোঁজা হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। তবে নতুন আইনের পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক মানের ল্যাবরেটরি গড়া এবং তার জন্য যন্ত্রপাতি কেনা অত্যন্ত জরুরি। এই নিয়ে আলোচনা চলছে।”
ভেজাল রুখতে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খাবারের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে পুরসভার স্বাস্থ্য দফতর। খাবারের নমুনা সংগ্রহ করেন খাদ্য পরিদর্শক। নমুনা পরীক্ষা করেন ‘ফুড অ্যানালিস্ট’। বর্তমানে পুরসভার খাদ্য পরিদর্শকের সংখ্যা মাত্র ২৬। তাঁরাই পুরসভার ১৪১টি ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেন। পুরসভা সূত্রে খবর, বর্তমানে ল্যাবরেটরিতে আট জন ফুড অ্যানালিস্টের পদও খালি। খালি রয়েছে সাত জন ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্টের পদও। মেয়র পারিষদের আলোচনায় এই পদগুলিতে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হলেও তা বলবৎ করা হয়নি।
পুরসভায় নতুন খাদ্য পরিদর্শক নিয়োগ করা হচ্ছে না কেন?
পার্থপ্রতিম হাজারি জানান, ল্যাবরেটরির মান উন্নত করলে তবেই খাদ্য পরিদর্শক এবং অ্যানালিস্ট নিয়োগের প্রশ্ন আসে। তার আগে লাভ নেই। আধুনিক মানের ল্যাবরেটরি নির্মাণের বিষয়টি মাথায় রেখেই নিয়োগের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পুর-সমীক্ষা থেকেই জানা গিয়েছে, পুরসভা প্রতি মাসে প্রায় ৩০টি খাবারের নমুনা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে গড়ে ১০-১২ শতাংশ নমুনায় ভেজাল পাওয়া যায়। কলকাতা পুরসভা সূত্রে খবর, ২০১০ থেকে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৫০টি খাবারের নমুনা সংগৃহীত হয়েছিল। তার মধ্যে ৫০টিতে ভেজাল পাওয়া যায়। কিন্তু খাবারের নমুনায় ভেজাল আছে কি না, তার মাত্র কয়েকটি নির্দিষ্ট পরীক্ষা হয় পুরনো ল্যাবরেটরিতে। পুরসভার আইনানুযায়ী বাইরের কোনও ল্যাবে এই ধরনের পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তাই বাইরের কোনও ল্যাবে এই নমুনা পরীক্ষা হয় না। ফলে, কোন খাবারে কতটা ভেজাল মেশানো, তা অনেক ক্ষেত্রেই জানা যায় না বলে স্বাস্থ্য আধিকারিক জানান।
পুরসভার মুখ্য ফুড অ্যানালিস্ট শঙ্করপ্রসাদ দেবনাথ বলেন, “পুরসভার এই ল্যাবরেটরি অনেক দিন আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে এই ল্যাবরেটরিতে উন্নত মানের যন্ত্র না থাকায় সব পরীক্ষা করা যায় না। কর্মীরও অভাব রয়েছে। পুর-কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়েছি।” পুর-কর্তৃপক্ষেরও বক্তব্য, বর্তমানে ল্যাবরেটরিতে খাবার বা পানীয়ের নমুনায় কী পরিমাণ রং ব্যবহার করা হয়েছে, খাবারের নমুনায় কতটা ধুলো রয়েছে এবং ডাল বা চালের নমুনায় কোনও পোকামাকড় রয়েছে কি না, কেবল এইগুলোই বর্তমান ল্যাবরেটরির পরিকাঠামোয় পরীক্ষা করা সম্ভব।

ছবি: বিশ্বনাথ বণিক




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.