ব্যাগ গুছিয়ে...
ভূস্বর্গের সন্ধানে
ভোর থেকে উঠেই মন খারাপ। মেঘের মিনার আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে রয়েছে। দেখেই বুঝলাম, বৃষ্টির বার্তা অবধারিত। পহেলগাঁও থেকে গুলমার্গের পথে লিডার নদী, ‘দরিয়া ঝালেম’ (ঝিলম নদী), সব ফেলে একে একে আরও উঁচুতে মেঘের বাড়িতে হানা দিলাম। হলুদ সর্ষের ক্ষেত, আপেল বাগান পেরতে পেরতে যেন ঝাঁপানে করে সোজা টানমার্গ পেরিয়ে গুলমার্গ এল ঝপ করে। সামনে ম্যাজেস্টিক ওয়ালপেপারের মতো রুপোলি ল্যান্ডস্কেপ, দিগন্তরেখা জুড়ে হিমালয় আর হিমালয়। দু’পাশে সবুজ ফরাস বিছানো। উত্তরাখণ্ড বা হিমাচলের কোনও উপত্যকায় সমতলের এতটা আধিক্য চোখে পড়েনি।
শ্রীনগরের কাছে যেমন গরম ছিল, গুলমার্গে পৌঁছেই ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করে দিল। বুঝলাম অনেক উঁচুতে আমরা। এখানে প্লাস্টিকের প্রবেশ নিষেধ। লোমের জ্যাকেট, গামবুট ভাড়া করে পাকদণ্ডী ধরে ওঠা। ক্রমশ শীতল থেকে শীতলতর হল। কচি সবুজ প্রান্তরে এ-ধার ও-ধার লোমশ ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে। দূর দিগন্তে চির, ফার, পাইন, দেওদারের ঘন সবুজ বন। যেন নীল আকাশের বুকে লীন হয়ে গেছে গাছেরা। শীতলতায় স্তব্ধ তাদের নড়াচড়া। এ বার কোনিফেরাস অরণ্যের মধ্য দিয়ে চলা। দু’পাশে পাহারারত সিআরপিএফ জওয়ান। নয়নাভিরাম ভিউপয়েন্ট। ছবি নেওয়া হল।
কাশ্মীর ভ্যালি এল। পৃথিবীর সর্বোচ্চ গল্ফকোর্স। ঠুকঠাক গল্ফ খেলছেন কোনও খেলোয়াড়। গাড়ি সেই গল্ফকোর্সকে পাশ কাটিয়ে আরও পাইন আর দেওদারের মধ্য দিয়ে এসে পৌঁছল মস আর ফার্ন ঘেরা কাঠের হোটেল ঘরে। একটা কেতাদুরস্ত পশ্চিমী ঘরানার স্কি-হাটে বুকিং ছিল আমাদের। স্কি-হাটে মালপত্র রেখে একটা সেল্ফ সার্ভিস কাফেটেরিয়ায় টোম্যাটো সুপ আর চিজ বার্গার দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহার সারা হল। সেখানে পৌঁছেই শুনলাম, পর দিন ভোরে লাইন দিয়ে গন্ডোলা রাইডের টিকিট বুক করে নিতে হবে। ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ। অতএব, গাড়ির চালককে লাইন রাখতে বলে সশরীরে টিকিট কেনা হল গন্ডোলা বা কেব্ল কারের। রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চার। গুলমার্গে এসে মনে হল, সারা ভারতের সকল ভ্রমণপিপাসু মানুষ জমায়েত হয়েছে হিমালয়ের টানে। এত ভিড় সেখানে! যাঁদের পরিকল্পনায় গুলমার্গে রাত্রিবাস নেই তাঁরা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে চলে যাচ্ছেন। কারণ, এক দিন হাতে না থাকলে টিকিট পাওয়া দুষ্কর।
স্কি-হাটে কাটল গুলমার্গের অলস সন্ধেটুকু। ভূগোল বই আর সংবাদপত্রের সেই গুলমার্গ যার আশপাশে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। নামী সিনেমার শু্যটিং হয়েছে। এখন পাহাড়ি সন্ধে নেমে এসেছে সেই গুলমার্গের গায়ে ঝুপ করে। হোটেলের স্লোপিং ছাদগুলোতে আরামে বরফ শুয়ে থাকে শীতে। চলার পথ পুরো ঢেকে যায় বরফে। সেই প্রদোষে গুলমার্গের স্কি-হাটে বসে লিপিবদ্ধ করলাম হিমালয়ের রূপ। ঘন সবুজ পাহাড়ের কোল আলো করে কচি সবুজ সমতল। লোমশ ভেড়া চরছে আপন খুশিতে। দু’-একটি অনামিকা পাখির কুজন আর কদাচিৎ দাঁড়কাকের পরুষ শব্দে নির্জনতাই মোহময় করে তুলেছে গুলমার্গকে। প্রচুর নামগোত্রহীন ফুল ফুটে রয়েছে এলোমেলো ভাবে।
স্কি-হাটের নীচ দিয়ে একটু আবডালে পাহাড়ি সুড়ঙ্গপথ নেমে গেছে কোথায় কে জানে? খিলানমার্গের দিকে ঘোড়া তার সওয়ারি নিয়ে চলেছে। দুপুরে বৃষ্টি ঝরে মস ফার্নেরা আরও সবুজ। ঠিক যেন ফোটোশপড ল্যান্ডস্কেপ। ছপ্পর ফুঁড়ে ঈশ্বর বরফ দিয়েছেন ভূস্বর্গে, কত সুন্দর জলবায়ু, তবুও কত প্রতিকূলতা এই অঞ্চলের। ও পি নায়ারের গানের কলি মুখে মুখে আমাদের। ও দিকে ‘শাওন কি ঘটা ছায়ি’। যাই হোক, পর দিন ভোর ভোর স্নান ও প্রাতরাশ সেরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি মেখে জলকাদার মধ্য দিয়ে গন্ডোলার টিকিট হাতে নিয়ে গুলমার্গের সর্বোচ্চ পয়েন্ট দেখতে গেলাম।
অপার সেই রূপ গুলমার্গের! গন্ডোলা রাইডের দারুণ অভিজ্ঞতা আর সর্বোপরি বরফ দেখে মন ভরে গেল। ভাষায় এই রূপ বর্ণনা করা যায় না। ফিরে এসেই শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে পর দিন আবার সোনমার্গ যাওয়ার প্ল্যান। গানেরবাল শহর দিয়ে, ১০-১২ কিলোমিটার সুবিস্তৃত ডাল লেকের সৌন্দর্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে করতে পথচলা। ফুলের আর ফলের বাগান সঙ্গে চলল। এই পথেই লেহ-লাদাখ-কার্গিল যাওয়া যায়। এক দিকে কঙ্গনের পথে পথ চলে গেছে অমরনাথের দিকে। তখন পাহাড়ের গা-ঘেঁষে মেঘেদের দল ভেসে চলেছে। বেলা প্রায় দশটা। মাঝে মাঝেই মেঘ ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে পথ ভিজিয়ে দিল। এল সিন্ধু নদ। কস্তুরী, কেশর শিলাজিত বিক্রি হচ্ছে। থিকথিকে জনতার কলরব। দূর থেকে থ্যাজস গ্লেসিয়ারের ঝলক দেখলাম। রোদ পড়ে চিকচিক করছে সোনার মতো। এই বুঝি সেই স্বপ্নের সোনমার্গ! ৮৫৯০ ফুট উচ্চতা। দরিদ্র কাশ্মীরি বালকের হাত ধরে অভিজ্ঞতা হল দারুণ। উঁচু বরফের ঢাল থেকে গড়িয়ে পড়লাম নীচে। বরফ ছুঁলাম আবারও।
কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে নদী। ধারে ধারে ফুটে রয়েছে নাম না-জানা অচেনা ফুলেরা, হিমালয় ঘিরে রেখেছে সে উপত্যকা। বরফচুড়ো থেকে চোরা গ্লেসিয়ার তিরতির করে ঝরে পড়ে অবশেষে মিশেছে জলে। কাশ্মীরি শাল-আলোয়ান নিয়ে বিক্রিবাট্টাও চলছে নদী তীরে।
কাশ্মীরি ব্যবসায়ীদের মুখে এক কথা: কেবল তিনটি জিনিস দেখতে কাশ্মীরে পয়সা লাগে না। ‘হাওয়া, পানি আউর দেখনা’...দেখনা, মানে কিনুন না কিনুন, দেখতে তো আর পয়সা লাগে না! অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে শালের কদর করতে থাকি। এই মানুষগুলোর গরমকালেই যা ব্যবসাপাতি। অন্য সময়ে তো এদের না খেয়ে প্রায় মরতে হয়। কিনেও ফেলি দু’-একটা উপহার সামগ্রী। অবিশ্যি দরদাম না-করলে ভয়ানক ঠকার আশঙ্কা।

কী ভাবে যাবেন

ট্রেনে বা বিমানে শ্রীনগর। সেখানে থেকে গাড়ি ভাড়া করে গুলমার্গ ও সোনমার্গ।
কখন যাবেন
উপযুক্ত সময় এপ্রিল থেকে অক্টোবর।
কোথায় থাকবেন
শ্রীনগরে থাকার অসংখ্য হোটেল ও হাউসবোট আছে। গুলমার্গেও হোটেল আছে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.