মেরুদণ্ডে ঘা খেয়েও মাথা উঁচু করে বাঁচতে হাতে হাত
লিউডের ‘গুজারিশ’ নয়। তপন সিংহের ‘হুইলচেয়ার’ ছবির পরিণতিই বরং বেশি পছন্দ। তাই মেরুদণ্ডে হঠাৎ আঘাত পাওয়ায় জীবন বদলে গেলেও হার স্বীকার নয়। প্রতিকূলতার উজান ঠেলে ঘুরে দাঁড়াতে জোট বাঁধলেন শর্মিষ্ঠা, অপরূপা, বিতান, তমোনাশ, নন্দিনী বা সুদামেরা। বয়স, সামাজিক অবস্থানে বিস্তর ফারাক সত্ত্বেও জীবনের একটি বিপর্যয় যাঁদের পরস্পরের কাছাকাছি এনে ফেলেছে।
মেরুদণ্ডের উপরে বিষম আঘাতে শরীরের অর্ধেকটা অসাড় হয়ে গেলেও তাঁদের ভিতরের ঘাড় সোজা করে বাঁচার জেদ কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এক দল পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ তাই জোট বেঁধেছেন। বৃহস্পতিবার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি অনুষ্ঠানে নিজেদের সংগঠন গড়ে এই লড়াকুদের একসঙ্গে পথ চলা শুরু হল।
হুইলচেয়ার বা বিছানায় ‘বন্দি’ চলৎশক্তিহীনদের জন্য এ রাজ্যে এখনও চিকিৎসার পরিকাঠামোয় ব্যাপক খামতি। এই ধরনের বেশির ভাগ রোগীকেই ভেলোর বা দিল্লি ছুটতে হয় চিকিৎসার জন্য। অথচ বেঁচে থাকার দৈনন্দিন লড়াইয়ে ছোট-বড় সমস্যার শেষ নেই। মলমূত্র ত্যাগের সময় যে হয়েছে, সেটাও টের পান না তাঁদের অনেকে। কারও শরীরের একাংশে তীব্র আঘাত করলেও সাড় মেলে না। এই সব সমস্যার সঙ্গে রোজকার লড়াইয়ে পরস্পরের পাশে দাঁড়াতেই এগিয়ে এসেছেন তাঁরা। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়ে সাহায্য করা বা অভিভাবকদের সচেতন করার কাজ তো আছেই। এখনও পর্যম্ত এ কাজে সরকারি-বেসরকারি সাহায্যও নামমাত্র। মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচতে এ রাজ্যে যথাযথ পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যও আছে তাঁদের।
আমরাও পারি। হুইলচেয়ারের নাচে জীবনের জয়গান। —নিজস্ব চিত্র
আর জি করের শিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা সিংহ নিজেই কয়েক বছর আগে উঁচু থেকে পড়ে মারাত্মক আঘাত পেয়েছিলেন। মেরুদণ্ডের চোটে শয্যাশায়ী হওয়ার পরে শরীরে-মনে পরপর ঘা খেয়েছেন অজস্র। তবু অক্লেশে নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করে এখন বলতে পারেন, “শরীরে যখন আঘাত লাগেনি, তখন বরং অনেক সময়েই নানা অবসাদে বেশি কষ্ট পেতাম। এখন আমি বা আমার মতো মানুষদের মর্যাদার জন্য লড়তে রোখ চেপে গিয়েছে।” নিজের ফেসবুক প্রোফাইল ‘স্পাইনাল কর্ড (রিম)’-এ মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্তদের অনেকের সঙ্গেই নানান সমস্যার জ্বালাযন্ত্রণা ভাগ করে নিতেন শর্মিষ্ঠা। এ বার তিনিই বন্ধুদের জড়ো করে সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
এই বন্ধুদের জমায়েতে যোগ দিতেই পশ্চিম মেদিনীপুরের মোহনপুরের পাড়ুই গ্রাম থেকে অনেক কষ্টে কলকাতায় এসেছেন বিতান দাস। বসতে পর্যন্ত পারেন না তিনি। দু’দশক আগে তেঁতুল গাছ থেকে পড়ে দুর্ঘটনার পরে গৃহশিক্ষকতা করে দিন চলে তাঁর। আড়াই বছর বয়সে দুর্ঘটনার পরে হাল না-ছাড়া তিরিশের যুবক সুদাম পালও নিজেকে আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা ভাবেন না। বেসরকারি সংস্থার ওই কর্মীর প্রত্যয়, “শহুরে যানবাহন বা অফিসে আমাদের শারীরিক অসুবিধার দিকগুলো একটু মাথায় রাখা হলেই দিব্যি আর সবার মতো বাঁচতে পারব।” বেহালার কলেজ-শিক্ষিকা নন্দিনী রায় মনে করিয়ে দিলেন, মেরুদণ্ডের আঘাতে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের মধ্যে নারী ও পুরুষের সমস্যা আলাদা। শহর আর গ্রামেও আলাদা আলাদা সমস্যা। তা সত্ত্বেও সকলে যদি এক মঞ্চে এসে দাঁড়াতে পারেন, জীবন অবশ্যই সহজ হয়ে যাবে।
‘গুজারিশ’ ছবির শেষটা তাই কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না শর্মিষ্ঠা। তাঁর কথায়, “ইচ্ছামৃত্যুর আর্জি দেখলে মাথা গরম হয়ে যায়! আমাদের শরীরের সমস্যাটা খুবই বড়। তা বলে জীবন ফুরিয়ে গিয়েছে, কে বলল?” তপন সিংহের হুইলচেয়ারের ডাক্তারের মতো ইতিবাচক মানুষেরাই শর্মিষ্ঠা-নন্দিনীদের প্রেরণা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থাতেই যাঁরা নতুন করে বাঁচার আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.