আফগানিস্তানে যুদ্ধরত ন্যাটো বাহিনীর কাছে যুদ্ধাস্ত্র, সাজসরঞ্জাম, রসদ এবং খাদ্য-পানীয়-ঔষধপত্র পৌঁছাইয়া দিবার পথটি পাকিস্তানের মধ্য দিয়া। সেই পথে ন্যাটোর রসদবাহী ট্রাকের কনভয়-যাত্রা নিরুপদ্রব করিতে পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি আফগানিস্তানে ন্যাটোর সামরিক সাফল্যের প্রধান পূর্বশর্ত। ন্যাটোর বিমান-হানায় দুই ডজন পাক সেনার মৃত্যুর পরবর্তী মনোমালিন্য দূর না হইলে সড়কপথে ওই রসদ চলাচল বন্ধই থাকিয়া যাইত। তাহা উপলব্ধি করিয়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারের কাছে দুঃখপ্রকাশ করিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তান যে মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টনের কাছ হইতে ওই বিলম্বিত ‘দুঃখপ্রকাশ’ আদায় করিয়া লইতে পারিয়াছে, ইহা পাক সরকার ও কূটনীতির উল্লেখযোগ্য সাফল্য। কেননা সরবরাহ-পথ বন্ধ থাকায় পাক-মার্কিন সম্পর্ক এমন তলানিতে আসিয়া ঠেকিয়াছিল যে, ইসলামাবাদকে দেওয়া মার্কিন অর্থ ও সামরিক সাহায্যও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
ন্যাটোর বিমান-হানায় পাক সৈন্যদের মৃত্যুর সমাচার সমগ্র পাকিস্তানের জনমানসে উগ্র মার্কিন-বিরোধী জাতীয়তাবাদ জাগাইয়া তোলে। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব খর্বকারী যে কোনও আগ্রাসী মার্কিন কিংবা ন্যাটো ক্রিয়াকলাপ জেহাদিদের প্রচার ও আন্দোলনকে বৈধতা দিতে বাধ্য। ইসলামাবাদকে তাই অত্যন্ত সাবধানতার সহিত অগ্রসর হইতে হয়। পাকিস্তানের দেওবন্দি মাদ্রাসায় তালিবানের জন্ম ও বিকাশ। আজ সেই তালিবানকে শায়েস্তা করিতে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী ইসলামাবাদের ঘাড়ে বন্দুক রাখিয়া আফগানিস্তানের যুদ্ধমঞ্চে অবতীর্ণ হইয়াছে। পাক জনমত কেমন করিয়া তাহা সমর্থন করিবে? উপরন্তু মার্কিন ড্রোনের ক্ষেপণাস্ত্র একের পর এক পাক ভূখণ্ডে আছড়াইয়া পড়িতেছে এবং ন্যাটোর বিমানও ‘ভুলক্রমে’ পাক সৈন্যদের গুলি করিয়া মারিয়া ফেলিতেছে?
পাকিস্তানের শাসকদের পক্ষে একই সঙ্গে জেহাদি গোষ্ঠী-প্রভাবিত জনমতকে নিজের অনুকূলে ঘোরানো এবং মার্কিন সহযোগিতা প্রাপ্তির পূর্বশর্তগুলি পূরণ করা উত্তরোত্তর দুরূহ হইয়া পড়িতেছে। বস্তুত, ওয়াশিংটনের সহিত ইসলামাবাদের দশ বছর আগেকার সমীকরণ আর নাই। মার্কিন কংগ্রেসে পাকিস্তানকে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ হিসাবে শনাক্ত করিয়া তাহাকে আর্থিক সহায়তা দান বন্ধ করার দাবি ক্রমেই জোরালো হইতেছে। পাকিস্তানেও পাক সার্বভৌমত্বের উপর মার্কিন হস্তক্ষেপ লইয়া জেহাদিদের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিশেষত আইএসআই এবং অতিশয় প্রভাবশালী বিচারবিভাগের মধ্যেও তীব্র বিরূপতা সৃষ্টি হইয়াছে। এই দুই বিপরীতমুখী প্রবণতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করিয়া চলা প্রায় অসম্ভব। তবু পরস্পরের স্বার্থে আমেরিকা ও পাকিস্তান উভয়েই সাময়িক আপস করিয়া চলিয়াছে। সড়কপথে রসদবাহী কনভয় চলিতে দিবার বিনিময়ে পাকিস্তান বছরে ১১০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থসাহায্য পাইতে চুক্তিবদ্ধ হইয়াছে। ইহাই আমেরিকার ‘ভুলের মাসুল’। জেহাদি জঙ্গিরাও এই বন্দোবস্তে উপকৃত। নিরাপদ যাতায়াতের বিনিময়ে কনভয় হইতে তোলা আদায় ছাড়াও প্রয়োজনে রসদ-বোঝাই ট্রাক লুঠ করিয়া নিজেদের সমৃদ্ধ করার সম্ভাবনা কে-ই বা স্বেচ্ছায় ত্যাগ করিতে চায়? ইসলামাবাদ হয়তো সীমান্ত প্রদেশে ড্রোন-হানা চলিতে দেওয়ার বিনিময়েও অনুরূপ বন্দোবস্তে চুক্তিবদ্ধ হইবে। যুদ্ধ ভাল বাণিজ্যও বটে! |