জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এ দেশে আপাতত শেষের দিক হইতে প্রথম পাঁচ জনের এক জন। ক্রমান্বয়ে সুদের হার বাড়াইয়া যে উচ্চতায় পৌঁছাইয়া দিয়াছে, তাহা হইতে নামিবার কোনও লক্ষণ নাই, কোনও আশাও নাই। প্রথম তিন মাসের আর্থিক নীতি কেমন কাজ করিল, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাহার রিপোর্ট প্রকাশ করিয়াছে। এই সমাচারের সহিত আর্থিক নীতির পরিবর্তনের ঘোষণাও প্রচারিত হইয়া থাকে। এ যাত্রা পরিবর্তন যৎসামান্য। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে আপন আমানতের একটি অংশ সরকারি ঋণপত্র হিসাবে মজুত রাখিতে হয়, তাহার বিধিবদ্ধ অনুপাত (স্ট্যাটিউটরি লিকুইডিটি রেশিয়ো বা এস এল আর) ২৪ শতাংশ হইতে কমিয়া ২৩ শতাংশ হইয়াছে। আর কোনও পরিবর্তন নাই, ব্যাঙ্ক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে ঋণ লইলে যে হারে সুদ মিটাইতে হয়, সেই হার (রিপারচেজ বা রেপো রেট) অপরিবর্তিত। ব্যাঙ্কগুলিকে আমানতের যে অংশ নগদ হিসাবে ধরিয়া রাখিতে হয় সেই অনুপাতও (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিয়ো বা সি আর আর) অবিচল। শিল্পবাণিজ্য মহল স্বভাবতই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রতি প্রীত নহে, কারণ সুদের হার বেশি থাকিলে ব্যবসায়ের খরচ বেশি হয়। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারও চড়া সুদ পছন্দ করে না, কারণ প্রথমত, চড়া সুদ তাহাদেরও খরচ বাড়ায় এবং দ্বিতীয়ত, সুদের হার চড়া থাকিলে বিনিয়োগ ও আয়বৃদ্ধির গতি ব্যাহত হয়। অর্থাৎ, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ইদানীং যে খলনায়কের ভূমিকায় প্রতিভাত হইতেছে, এই ত্রৈমাসিক সমীক্ষার পরেও সেই ভূমিকা অপরিবর্তিত।
ইহা কি সঙ্গত? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কি সত্যই খলনায়ক? এই প্রতিষ্ঠানের মূল কর্তব্য কী? কেবল ভারতে নয়, সাধারণ ভাবে যে কোনও দেশে মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হিসাবে সাব্যস্ত হইয়াছে। যখন দেশে মূল্যবৃদ্ধির গতি বাড়িয়া যায়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের এক নম্বর কাজ হয় অর্থের তথা ব্যাঙ্কঋণের জোগান নিয়ন্ত্রণে রাখা, কারণ ঋণের জোগান স্ফীত হইলে অর্থনীতিতে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা স্ফীত হয়, তাহার ফলে মূল্যস্ফীতি ঘটে। ভারতে ঠিক সেই অবস্থাই চলিতেছে, মূল্যবৃদ্ধির গতি বিপজ্জনক রকমের বেশি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনুমান করিয়াছে, পাইকারি মূল্য সূচক সাত শতাংশ বাড়িবে। ইহাই যথেষ্ট চড়া হার, তদুপরি রহিয়াছে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খরা পরিস্থিতির আশঙ্কা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তৈলবীজের মূল্যস্ফীতি। সুতরাং, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্পষ্ট যুক্তি, সুদের হার কমাইলে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্কট আরও বাড়িত। বস্তুত, এস এল আর কমাইবার ফলে ব্যাঙ্কের হাতে ঋণ দেওয়ার মতো অতিরিক্ত অর্থ আসিয়াছে, ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের সুদ কমিবে, ইতিমধ্যেই কমিতেছে। সুতরাং, রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে খলনায়ক বলা চলে না।
সমস্যা অন্যত্র। বাজারে ঋণের যে জোগান রহিয়াছে, তাহার বিরাট অংশ সরকারি ঋণের চাহিদা মিটাইতে চলিয়া যাইতেছে। সরকারি ঋণ বিপুল, কারণ সরকারের ঘাটতি বিপুল। সরকারি ঘাটতি বিপুল, কারণ সরকারের আয়ের তুলনায় ব্যয় অত্যধিক। এই সমস্যা কমিলে ঋণের বাজারে স্বাভাবিক ভাবেই অবস্থার উন্নতি ঘটিবে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপর নির্ভর করিতে হইবে না। কিন্তু সরকারি ব্যয় কমাইবার জন্য সরকারের সাহস প্রয়োজন। মনমোহন সিংহের সরকারের ঝুলিতে সেই বস্তুটির এখনও ঘোর অনটন। পাশাপাশি, বেশ কিছু বৃহৎ বেসরকারি সংস্থার হাতে বিনিয়োগের জন্য বড় অঙ্কের অর্থ রহিয়াছে, কিন্তু তাহারা বিনিয়োগ করিতেছে না, তাহারা বিনিয়োগ করিয়া লাভের আশা দেখিতেছে না। এই নৈরাশ্য হইতে বিনিয়োগকারীদের উদ্ধারের জন্য অবিলম্বে সরকারি নীতি এবং সিদ্ধান্ত স্থির করিবার প্রক্রিয়াটিকে তৎপর করা জরুরি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত কাজ করা জরুরি। তাহা না হইলে আয়বৃদ্ধির হার সাড়ে ছয় শতাংশ হইতে আরও নীচে নামিবে। বল এখন নূতন অর্থমন্ত্রীর কোর্টে। |