ত্রিফলা ‘চাপে’র মুখে শেষ পর্যন্ত পিছু হঠল সিপিএম। বাস-মালিকদের পরে এ বার কাল, মঙ্গলবারের পরিবহণ ধর্মঘট থেকে পিছিয়ে এল সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটু। ধর্মঘট মোকাবিলায় কড়া অবস্থানে অনড় থেকে ফল পেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে রাজ্যবাসীও স্বস্তি পেলেন।
‘বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মসূচি’র কারণ দেখিয়ে পরিবহণ ধর্মঘট আপাতত ‘স্থগিত’ রাখার কথা রবিবার ঘোষণা করেছে সিটু। সিটু-নেতৃত্বের বক্তব্য, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর আবেদনে সাড়া দিয়েই তাদের এই সিদ্ধান্ত। সিপিএমের একাংশের মতে, পরিবহণ ধর্মঘট থেকে দলের শ্রমিক সংগঠনকে বিরত করে দলের রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু ‘বাস্তব বিবেচনাবোধের’ পরিচয় দিয়েছেন। এই মহলের ব্যাখ্যা, সপ্তাহের গোড়ায় ভরা কাজের দিনে সিটু পরিবহণ অচল করার ডাক দেওয়ায় জনমানসে এমনিতেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছিল। উপরন্তু সিটু ‘একতরফা’ ভাবে ধর্মঘট ঘোষণা করায় বামফ্রন্টের তিন শরিক দলের শ্রমিক সংগঠনও ধর্মঘটের কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। এ দিকে সরকারের আবেদনে সাড়া দিয়ে শনিবার বাস-মালিকদের সংগঠনগুলি ৩১ জুলাইয়ের প্রস্তাবিত ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের ‘কড়া অবস্থানের’ মুখে দাঁড়িয়ে একক শক্তিতে ধর্মঘট করতে গেলে সিটু-র শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ভাবে একঘরে হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল বলে সিপিএমের এই অংশের অভিমত।
সিটু-র সিদ্ধান্তকে রাজ্য সরকারের তরফে এ দিন স্বাগত জানিয়ে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “ধর্মঘট করে কোনও রাজ্যই সুফল পায়নি। ধর্মঘট প্রত্যাহার ভাল লক্ষণ।” তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র সভানেত্রী দোলা সেনের কথায়, “২৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ ধর্মঘট ব্যর্থ হওয়ার পরে ওরা (সিটু) বুঝেছিল যে, এখানে ধর্মঘটে বিশেষ সাড়া আর পাবে না। |
বিমানবাবু আবেদন করেছেন, বৃহত্তর আন্দোলন কর্মসূচি নেওয়া
হয়েছে, ধর্মঘট স্থগিত রাখুন। আমরা ধর্মঘট স্থগিত রাখছি।
শ্যামল চক্রবর্তী,
সিটুর রাজ্য সভাপতি |
|
বাস-মালিকেরা ধর্মঘট ডাকছেন দেখে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ওরা সমর্থন করেছিল। এ বার সেই মালিকেরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করায় এবং সরকার ওদের না-ডাকায় সিটু বাধ্য হল ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিতে।” কংগ্রেসের ট্রেড ইউনিয়ন আইএনটিইউসি বলেছে, ধর্মঘট হলে একটা কাজের দিন নষ্ট হত।
পরিবহণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত থেকে সিটু যে পিছিয়ে আসতে পারে, তার আভাস অবশ্য গত দু’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল। মূল্যবৃদ্ধি থেকে শুরু করে পরিবহণ-সহ নানা ক্ষেত্রের ‘জ্বলন্ত সমস্যা’ নিয়ে আগামী ১ থেকে ৩ অগস্ট কলকাতায় অবস্থান-বিক্ষোভের কর্মসূচি নিয়েছে বামফ্রন্ট। তার মধ্যে ২ তারিখে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলিকে ওই বিক্ষোভ-অবস্থানে বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সিটু যাতে তাদের ৩১ তারিখের পরিবহণ ধর্মঘট স্থগিত রাখে, সে জন্য শ্রমিক সংগঠনটির নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমানবাবু। সিটু-অনুমোদিত পশ্চিমবঙ্গ জনপথ পরিবহণকর্মী ফেডারেশনকে এ ব্যাপারে লিখিত আবেদনও জানান তিনি। তার পরেই সিটুর তরফে শ্যামল চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রাজদেও গোয়ালা, অনাদি সাহুরা ধর্মঘট স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করেন। সিটু-র রাজ্য সভাপতি শ্যামলবাবু এ দিন বলেন, “বিমানবাবু আবেদন করেছেন, যে হেতু বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, সে জন্য এখন ধর্মঘট স্থগিত রাখুন। আমরা বামফ্রন্ট চেয়ারম্যানের আবেদনে সাড়া দিয়ে আপাতত ধর্মঘট স্থগিত রাখছি।” মঙ্গলবার রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলির অবস্থান-সমাবেশের পরে রাজ্যপালের কাছে যাওয়ার কর্মসূচি অবশ্য বহাল থাকছে।
সিটু কেন একক ভাবে পরিবহণ ধর্মঘট ডাকতে গেল, এ প্রশ্নে প্রবল আপত্তি তুলেছিল যারা, সেই ফরওয়ার্ড ব্লকের শ্রমিক সংগঠন টিইউসিসি, আরএসপি-র ইউটিইউসি এবং সিপিআইয়ের এআইটিইউসি’কেও ধর্মঘট স্থগিত রাখার কথা জানিয়ে দেন সিটু নেতৃত্ব। সিদ্ধান্তটি প্রকাশ্যে ঘোষণা করার আগেই।
মুখ্যমন্ত্রীর ‘হুঁশিয়ারি’তেই কি আপাতত পিছু হঠা?
সিটু নেতৃত্ব অবশ্য তা মানতে নারাজ। সিটু-র রাজ্য সভাপতি শ্যামলবাবুর দাবি, “কোনও হুমকির কাছে আত্মসমর্পণ এটা নয়। হুমকি তো ২৮ ফেব্রুয়ারিও ছিল! তখন তো মানুষ ধর্মঘট করে দেখিয়ে দিয়েছেন! তা ছাড়া সাতের দশকে কংগ্রেস যে ভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে হুমকি দিয়েছিল, তার পরে ৩৪ বছর বাংলার মানুষ তাদের সরকারে আনেননি।”
তা হলে কি বামফ্রন্টের মধ্যে প্রতিবাদের জেরে পিছিয়ে আসতে হল?
শ্যামলবাবুর ব্যাখ্যা, “এটা বামফ্রন্টের ব্যাপারই নয়। ট্রেড ইউনিয়নে বামফ্রন্টের কোনও কমিটি নেই। বামফ্রন্টের ট্রেড ইউনিয়নের কেউ ধর্মঘটের বিরোধিতা করেনি।” জনপথ ইউনিয়নের সম্পাদক সুভাষবাবুর বক্তব্য, “বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তি এই বিষয়গুলিকে গ্রহণ করে নেওয়ায় এটাকে আমাদের দাবির পক্ষে অগ্রগতি বলেই ধরে নিয়েছি।” সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “রাজনীতি দীর্ঘমেয়াদি লড়াই। সেখানে কৌশলগত পিছু হঠাও একটা কৌশল।”
আপাতত সেই ‘কৌশলের’ আড়ালেই আশ্রয় নিতে হল সিটু নেতৃত্বকে! |