|
|
|
|
পথের বাধা সরিয়েও অন্য অস্বস্তি |
ভোগান্তির স্কুল সার্ভিস পরীক্ষার শেষেও বিভ্রান্তি |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বিভ্রান্তি দিয়ে শুরু, বিভ্রান্তিতেই শেষ! রবিবারের স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার নির্যাস এটাই।
কোথাও দেরিতে, কোথাও বা পরীক্ষার্থীর তুলনায় কম সংখ্যায় প্রশ্নপত্র পৌঁছনো, কোথাও ভুল প্রশ্নপত্র, কারও অ্যাডমিট কার্ডে পরীক্ষাকেন্দ্রের ঠিকানা ভুল ছাপা এমন বহু কারণে এ দিন পরীক্ষার শুরু থেকেই হেনস্থা হতে হয় স্কুল সার্ভিসের বড় সংখ্যক পরীক্ষার্থীকে। এ দিন বিকেলে স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান চিত্তরঞ্জন মণ্ডল জানান, প্রশ্নপত্র বিভ্রাটের কারণে কয়েকটি বিষয়ে উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের সব ক’টি কেন্দ্রে ফের পরীক্ষা হবে। যে হেতু এ ক্ষেত্রে এক একটি অঞ্চলের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়, তাই বাতিল করতে হলে গোটা অঞ্চলের পরীক্ষাই বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নিতে হবে। তার কয়েক ঘণ্টা পরে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানান, অঞ্চলভিত্তিক নয়, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় স্থির হয়েছে, যে পাঁচটি কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়নি, কেবল সেখানেই ফের পরীক্ষা হবে। যদিও কোন পাঁচটি কেন্দ্রে ফের পরীক্ষা হবে, তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি তিনি। কমিশন কর্তৃপক্ষ ও রাজ্য সরকারের এই পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা ঘিরে বিভ্রান্তি চরমে পৌঁছয়। |
|
দেরিতে আসা প্রশ্নপত্র হাতে পরীক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। বাগনানে হিলটন ঘোষের তোলা ছবি। |
এ দিন ছিল এসএসসি-র লিখিত পরীক্ষা। ৫৫ হাজার শূন্য পদের জন্য রাজ্য জুড়ে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় বসেন। এই পরীক্ষায় দু’টি পত্র। প্রথম পত্র সংশ্লিষ্ট বিষয় আর দ্বিতীয় পত্রটি টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট (টেট)-এর আদলে তৈরি।
এ দিন পরীক্ষার শুরু থেকেই নানা বিভ্রাট দেখা দেয়। বাগনানের আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে যেমন ৬৩২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২১১ জনের কোনও প্রশ্নপত্রই (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র) আসেনি। অনেক দেরিতে প্রশ্নপত্র এলেও তাতে পরীক্ষা দিতে অস্বীকার করে বিক্ষোভ দেখান এক দল পরীক্ষার্থী। মালদহ মহিলা মহাবিদ্যালয়ে বাংলা (পাশ) বিষয়ের ৪৮৯ জন পরীক্ষার্থীর জন্য মাত্র ২৫টি প্রশ্নপত্র এসে পৌঁছয়! ফলে ওই কেন্দ্রে বাতিল হয় পরীক্ষা। চুঁচুড়ার দেশবন্ধু মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র না পৌঁছনোয় পরীক্ষা স্থগিত করে দেওয়া হয়। বর্ধমানের রাইপুর কাশিয়াড়া হাইস্কুল এবং রসুলপুর ভুবনমোহন হাইস্কুলে দুই পর্বেরই প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র পৌঁছতে দেরি হয়। দুই কেন্দ্রেই পরীক্ষা হয়নি। এ ছাড়াও কোথাও ফটোকপি করা প্রশ্নপত্র বিলি হয় পরীক্ষার্থীদের মধ্যে। কোথাও ভুল প্রশ্নপত্র বিলি হয়েছে, কোথাও বা অ্যাডমিট কার্ডে ভুল থাকায় সমস্যায় পড়েছেন পরীক্ষার্থীরা।
একের পর এক গোলমালের খবর আসতে থাকায় দুপুরেই শিক্ষামন্ত্রী কথা বলেন কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে। কোথায় কোথায় কী গোলমাল হয়েছে, চিত্তরঞ্জনবাবুর কাছে বিস্তারিত ভাবে সেই রিপোর্ট চান ব্রাত্যবাবু। সাংবাদিক বৈঠক করে বিষয়টি স্পষ্ট করে জানানোর নির্দেশও দেন তিনি। |
চিত্তরঞ্জন মণ্ডল চেয়ারম্যান (এসএসসি) |
ব্রাত্য বসু ,
শিক্ষামন্ত্রী |
গোটা উত্তরাঞ্চলে বাংলা, উর্দু পাশ এবং পূর্বাঞ্চলে
কয়েকটি বিষয়ে ফের পরীক্ষা নেওয়া হবে। |
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ঠিক হয়েছে, পরীক্ষা না
হওয়া পাঁচ কেন্দ্রেই শুধু ফের পরীক্ষা নেওয়া হবে। |
|
বিভ্রান্তি কোথায়?
এই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাটি হয় গোটা অঞ্চলের মধ্যে, তাই গোটা অঞ্চলের পরীক্ষাই বাতিল করে ফের পরীক্ষা নিতে হবে অঞ্চলের সব কেন্দ্রে। এসএসসি চেয়ারম্যান তা-ই বলেছেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী পাঁচ কেন্দ্রে পরীক্ষার কথা বলায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। |
|
কী বিভ্রাট
•
কোথাও প্রশ্নপত্র এল না
•
কোথাও এল দেরিতে
•
কোথাও কম প্রশ্নপত্র
•
কোথাও ভুল প্রশ্ন বিলি
•
কোথাও অ্যাডমিট কার্ডে ভুল |
|
কেন বিভ্রাট
• কম প্রশ্নপত্র, তাই সমস্যা
•
কেন্দ্রওয়াড়ি পরীক্ষার্থীর হিসেবে গলদ
•
কেন্দ্র, ট্রেজারিতে বাড়তি প্রশ্ন না রাখা
•
কেন্দ্রীয়-আঞ্চলিক অফিসে সমন্বয়ের অভাব
•
পরিচালনার দায়িত্বে অভিজ্ঞের অভাব |
চিত্তরঞ্জন মণ্ডলের ছবি এবিপি আনন্দের সৌজন্যে |
|
|
পরে চিত্তরঞ্জনবাবু জানান, কী করে এমন গোলমাল হল, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গড়া হবে। সেই সঙ্গেই তাঁর দাবি, ‘মুষ্টিমেয়’ কিছু কেন্দ্র ছাড়া সর্বত্র পরীক্ষা সুষ্ঠু ভাবে হয়েছে। যদিও তাঁর দেওয়া তথ্যই অন্য কথা বলছে। তিনি নিজেই জানান, উত্তরাঞ্চল (যার মধ্যে আছে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দুই দিনাজপুর এবং শিলিগুড়ি মহকুমা), পূর্বাঞ্চল (হুগলি, বীরভূম ও বর্ধমান) এবং দক্ষিণাঞ্চলে (হাওড়া, কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা) গোলমাল হয়েছে। পরীক্ষা নির্বিঘ্নে হয়েছে কেবল পশ্চিমাঞ্চল (বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর) এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে (উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়া)।
১৯৯৮ সাল থেকে এসএসসি-র এই শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা শুরু। এমন ঘটনা আগে হয়নি বলেই কমিশন সূত্রের খবর। এ বছর এত গোলমাল হল কেন? পূর্ব পরিকল্পিত ভাবেই এই গণ্ডগোল করা হয়েছে বলে ইঙ্গিত দেন চেয়ারম্যান। যদিও কে বা কারা এর পিছনে রয়েছেন, তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি তিনি। চিত্তরঞ্জনবাবু বলেন, “আমি জানতাম যে, এসএসসি-র পরীক্ষা ফের নিতে বাধ্য করা হবে বলে প্রচার চালিয়েছিল কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি। একটা অশান্তি করার চেষ্টা যে চলছে, সেটা আঁচ করতে পেরেছিলাম।” |
|
|
স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা নির্বিঘ্নেই চলছে
গোঘাটের স্কুলে। মোহন দাসের তোলা ছবি। |
চুঁচুড়ায় দেশবন্ধু উচ্চবিদ্যালয়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনের
পরীক্ষা নিয়ে ছড়াল উত্তেজনা। তাপস ঘোষের তোলা ছবি। |
|
কমিশন কেন আগাম সতর্ক হল না? চেয়ারম্যানের দাবি, যথেষ্ট পরিকাঠামো নিয়ে সুপরিকল্পিত ভাবেই পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কী করে এমন ঘটল, তা তাঁর বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি বলেন, “গোলমালের জন্য কমিশন বা প্রশাসন, কে যে ঠিক দায়ী, সেটা এখনই বলা যাবে না। তদন্ত কমিটি গড়ে এর কারণ খতিয়ে দেখা হবে।” একই সঙ্গে তিনি এ-ও বলেছেন, “সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রশ্নপত্র দেরিতে আসায় অনেক জায়গায় টেট পরীক্ষাও দেননি পরীক্ষার্থীরা। যাঁরা টেট না দিয়ে চলে গিয়েছেন, তাঁদের দায়িত্ব রাজ্য সরকার বা কমিশনের নয়।” তাঁদের আর পরীক্ষা নেওয়া হবে না বলেই তিনি জানান। তবে অনেক পরীক্ষা কেন্দ্রে টেট-এর প্রশ্ন পৌঁছতেই কেন দেরি হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তিনি। পাশাপাশি জানিয়েছেন, উত্তরাঞ্চলে বাংলা (পাশ) ও উর্দু (পাশ)-এর পরীক্ষা এবং পূর্বাঞ্চলেও কয়েকটি বিষয়ে ফের পরীক্ষা নেওয়া হবে। পূর্বাঞ্চলে কোন কোন বিষয়ের পরীক্ষা হবে, তা এখনও স্থির হয়নি বলেই চিত্তরঞ্জনবাবু জানান।
এ দিনের ঘটনার নিন্দা করে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “কেন এমন হল, রাজ্য সরকারের তা তদন্ত করে দেখা উচিত। পরীক্ষার্থীরা দাবি জানালে আবার পরীক্ষাও নেওয়া উচিত।” আটটি বামপন্থী শিক্ষক সমিতিও এ দিনের ঘটনার নিন্দা করে। নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির (এবিটিএ) চেয়ারম্যান উৎপল রায় বলেন, “রবিবারের পরীক্ষায় যে সব ঘটনা সমনে এসেছে, তাতে সারা রাজ্যে পরীক্ষা বাতিল করার মতো ঘটনা ঘটেছে।” |
|
|
|
|
|