যে পথ কেড়ে নিয়েছে তাঁর ছেলেকে, সেই পথকেই নিরাপদ করার কাজে মন দিয়েছেন তিনি!
রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় মারা গিয়েছিল বছর চব্বিশের ছেলেটা। দশ বছর আগে। নদিয়ার করিমপুরের যুবক নির্মল সাহার সেই মর্মান্তিক মৃত্যুর স্মৃতি এখনও তাড়া করে তার পরিবারকে। সাহা পরিবার এ বার এগিয়ে এসেছে এক অভিনব পুরস্কার নিয়ে! নির্মলের স্মৃতিতে ওঁরা পুরস্কার দিচ্ছেন সেই সব চালককে, যাঁরা আইন মেনে বাসচালনার নজির গড়ছেন! গত এক বছরে এমন কৃতিত্বের দাবিদার সাত বাসচালককে পুরস্কার দেওয়া হল শনিবার। নির্মলের দাদা দুর্গা সাহার চোখে তখন জল ছলছল করছে।
পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু সর্বত্র বাড়ছে এই সংবাদ ‘শিরোনামে’র ভিড়। কাঠগড়ায় কখনও পথচারীর অসতর্কতা, কখনও বাসচালকের। বাসে বাসে রেষারেষি, ট্রাফিক আইন ভাঙার প্রবণতা নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগ ভূরি ভূরি। |
দুর্ঘটনার পরে জনতার রোষ, বাসে আগুন দেওয়ার দৃশ্যও প্রায় প্রতিদিনের। যাত্রী তথা জনতার সঙ্গে চালক-কন্ডাক্টরদের সম্পর্ক অনেকাংশেই তলানিতে ঠেকেছে। এই পরিস্থিতিতে সাহা পরিবারের উদ্যোগ সর্বার্থেই অভিনব। বাসচালকদের প্রতি অসন্তোষ জমিয়ে তোলা নয়, বরং সুষ্ঠু ভাবে বাস চালানোয় উৎসাহ দেওয়াই লক্ষ্য, বলছেন দুর্গাবাবু। মা রেখাদেবী বলেন, “এক ছেলে মারা যায় আমার কোলে। আর এক ছেলে যখন বলল, চালকদের উৎসাহ দিলে আর কারও ছেলে এমন অকালে চলে যাবে না, তখন রাজি হয়ে গেলাম।”
দশ বছর আগের সেই সকালটা এখনও মনে পড়ে ওঁদের। সেলুনে চুল কাটতে গিয়েছিলেন নির্মল। করিমপুর গার্লস হাইস্কুলের পাশের রাস্তা পার হচ্ছিলেন। বেপরোয়া ছুটন্ত বাস তাঁকে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যায়। ক্লাস টেনের পর পড়াশোনা ছেড়ে দাদার সঙ্গে ফটোগ্রাফি স্টুডিওর ব্যবসায় নেমে পড়েছিলেন। দুর্গাবাবুর সেই স্টুডিওয় এখন নিজেই ফ্রেমবন্দি হয়ে তাকিয়ে আছে নির্মলের ফটোগ্রাফ। নির্মলের স্মৃতিতে পুরস্কার দেওয়ার চিন্তাটা কী ভাবে এল? সূত্রটা গড়ে দিয়েছিল করিমপুরের দূরপাল্লার বাসশ্রমিকদেরই গড়ে তোলা একটি ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। সোসাইটির সম্পাদক দিলীপ দাসের কথায়, “২০০৫ সালে দুর্ঘটনায় এক বাসচালকের পা বাদ যায়। তাঁর জন্য রক্ত সংগ্রহ করতে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গিয়েছিল। তখনই ঠিক করি, সোসাইটি গড়ব।” গত সাত বছর ধরে ২৮ জুলাই সোসাইটির তরফে একটি অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। সেখানে রক্তদান হয়, দুঃস্থদের সাহায্য করা হয়। গত বছর ওই অনুষ্ঠানেই পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেন দুর্গাবাবু। পুরস্কারের শর্তও তিনিই দেন এক বছরে দুর্ঘটনা তো দূরের কথা, কোনও রকম আইন না ভেঙে বাস চালাবেন যিনি, সেই চালক পুরস্কার পাবেন। |
|
|
রেখা সাহা। |
পথ দুর্ঘটনায় মৃত নির্মল। |
|
এ বছর সেই মোতাবেক আদর্শ চালকের পুরস্কার পেলেন শ্রীধর প্রধান, বিজন মণ্ডল, বাণী মণ্ডল, অজয় মণ্ডল, সুব্রত বিশ্বাস, কৃষ্ণচন্দ্র দাস এবং তপন সান্যাল। অজয় মণ্ডল বলছিলেন, “সারাক্ষণ গালমন্দই জোটে। ভাল চালানোর জন্য যে পুরস্কার দেওয়া হবে, ভাবতেই পারিনি।”
তাঁর পুরস্কার যে এমন ফলপ্রসূ হবে, ভাবতে পারেননি দুর্গাবাবুও। তাঁর কথায়, “আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি দেখে যে, কঠিন শর্ত পূরণ করেছেন সাত-সাত জন চালক।” শর্তটা যে সত্যিই কতটা কঠিন, তা চালক মাত্রেই জানেন। সোসাইটির সদস্য পার্থসারথি নন্দী জানান, করিমপুর থেকে কলকাতা প্রায় ২১০ কিলোমিটার পথ। এক জন চালক টানা এক সপ্তাহ বাস নিয়ে কলকাতা গিয়ে সে দিনই ফেরেন। তার পরে হয়তো দু’দিনের ছুটি। তাড়াতাড়ি চালানোর তাড়ার সঙ্গে একটু অসতর্ক হলেই দুর্ঘটনার ভয়। নদিয়ার আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক মলয় রায়ের আশা, “এই পুরস্কার বাস চালকদের আরও দায়িত্ববান করবে।” শুধু নদিয়া নয়, সার্বিক ভাবে রাজ্যের বাসচালকদের প্রতিই এটা বার্তা দেবে বলে মনে করছেন রাজ্যের জয়েন্ট সিন্ডিকেট অফ বাস সার্ভিস-এর যুগ্মসচিব তপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “যাত্রী ও চালকদের মধ্যে সচেতনতা প্রসার কর্মসূচির প্রস্তাব দিয়েছি সরকারকে। করিমপুর যে নজির গড়ল, তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।”
বাসে বাসে রেষারেষি পুরস্কারের অন্তরায়! কিন্তু পুরস্কারের জন্য আলাদা কোনও রেষারেষি? কৃষ্ণচন্দ্র দাস হেসে ফেলে বলেন, “সে রেষারেষি যত হয়, ততই ভাল।”
|