প্রদীপ বসুমাতারি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন সংবাদমাধ্যমের দিকেই, “ভাইয়ের সঙ্গে ভাইকে কে লড়িয়ে দিল বলুন তো?”
স্কুল শিক্ষক শঙ্করকৃষ্ণ ব্রহ্ম বিড়বিড় করছিলেন, “দাগ লেগে গেল, দাগ! এ দাগ মুছবে না। ইতিহাসে লেখা থাকবে, আন্তিহারা-তিতলিগুড়ির মানুষ বিনা দোষে একে অপরকে খুন করেছে, ঘরছাড়া করেছে। কিন্তু, আমরা কিচ্ছু করিনি, বিশ্বাস করুন। কারা যে এটা করল!”
এই প্রশ্নই দোতমা, আন্তিহারা, বঁড়শিঝড়া, নাওভিটা, ময়নাগুড়ির আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই চূড়ান্ত উগ্রপন্থার সময় থেকে ২০০৮ সালের সংঘর্ষ পর্যন্ত এই সব এলাকার সম্প্রীতিতে কেউ আঁচড় কাটতে পারেনি। কিন্তু, এ বার পেরেছে। পোড়া বাড়ি হয়তো আবার গড়ে উঠবে। কিন্তু ভাঙনের দাগটা কি আর মোছা যাবে?
সংঘর্ষের কেন্দ্রস্থল থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা পার হয়ে দোতমা গ্রাম। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মর জন্মস্থল। ১৯৮৫ সালে পৃথক বড়োল্যান্ডের দাবিতে তিনিই প্রথম আন্দোলন শুরু করেছিলেন, যার সূত্র ধরে পরবর্তী কালে বড়োল্যান্ড টাইগার্স ও এনডিএফবি-র জন্ম। “কত জঙ্গিপনা, সন্ত্রাস, গুলির লড়াই দেখেছে এই এলাকা,” এলাকার এক উপজাতি নেতা বলছিলেন, “কিন্তু সংখ্যালঘু, নেপালি, রাজবংশী ভাইদের গায়ে হাত পড়েনি।” গত সাতটা দিন সব বদলে দিল। মারপিট, খুনজখম। পুড়ে গিয়েছে ঘরবাড়ি। দুই পক্ষের মানুষই প্রাণ নিয়ে পালিয়েছেন। একে অন্যকে পালাতে সাহায্য করেছেন। নাওভিটায় এ দিন দেখা গেল, ধীরে ধীরে ঘরে ফেরা এক পক্ষের মানুষ অন্য পক্ষের পোড়া-আধপোড়া বাড়িগুলোর আশপাশে ঘুরছেন। তন্ন তন্ন করে খুঁজছেন যদি কোনও ফোন নম্বরের হদিস মেলে। কেউ যদি দামি কিছু ফেলে গিয়ে থাকেন, সযত্নে তুলে রাখবেন। ওঁরা ফিরে এলে ফেরত দেবেন। |
ঘরে ফিরছেন কোকরাঝাড়ের মানুষ। রবিবার। উজ্জ্বল দেবের তোলা ছবি। |
আপনারাই তো ওদের তাড়িয়েছেন, পুড়িয়ে দিয়েছেন ঘরবাড়ি!
ফুঁসে ওঠেন শঙ্কর ব্রহ্ম, সুমিত্রা বসুমাতারিরা। বলেন, “আমরা কেউ কারও গায়ে কখনও হাত তুলিনি। বরং ওঁদের পালাতে সাহায্য করেছি। আক্রমণ আসতে পারে সেই সতর্কবার্তা ওঁরাই আমাদের আগে থাকতে দিয়েছিলেন। যারা হামলা করেছে, সবাই বাইরের লোক। আমাদের পালাতে বলে, ওঁরাও পালালেন। ফিরে এসে দেখছি ওঁদের ঘর জ্বলেছে, আমাদেরও। যদি আমরা আগুন না দিয়ে থাকি, তো কারা দিল?”
খোদ মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ মেনে নিয়েছেন, সংঘর্ষের পিছনে ‘তৃতীয় শক্তি’র হাত ছিল। কেউ দোষ দিচ্ছেন অনুপ্রবেশকারীদের, কেউ জঙ্গিদের। কিন্তু এলাকার মানুষের মত, পিছনে পাকা মাথার পরিকল্পনা না থাকলে এই ভাবে সুপরিকল্পিত আঘাত হানা যেত না। যে ভাবে ট্রেনে চড়াও হয়েছে দুষ্কৃতীরা, তা সাধারণ গ্রামবাসীর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঘটনার পিছনে অন্য কোনও পক্ষের ইন্ধন থাকলে, খুঁজে বের করা হবে। কিন্তু নাওভিটা বা ময়নাগুড়ির গ্রামবাসীরা জানেন, রহস্যের উন্মোচন হয়তো কখনওই হবে না।
তিতলিগুড়ি মিড্ল ইংলিশ স্কুলে পড়ান শঙ্করবাবু। সিংহভাগ ছাত্রছাত্রীই সংখ্যালঘু। স্কুল এখন বন্ধ। কিন্তু খোলার পরেও, তাঁর আদরের ছেলেমেয়েদের কি আর ফিরে পাবেন? শঙ্করবাবু সাফ জানান, “সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার খবর আসতেই আমরা শান্তি-সভা করি। সবাই মিলে একজোট হয়ে ঠিক করেছিলাম, যে করে হোক ভাই-ভাইকে বাঁচাব। এখানকার এক জনকেও আমাদের উপরে হামলা করতে দেখিনি। কিন্তু এক দিন দলে দলে বাইরের মানুষ গ্রামে ঢুকে পড়লেন। দুই পক্ষের বাসিন্দারাই পুলিশকে বার বার আসতে অনুরোধ করি। কিন্তু পুলিশ বলল, আমাদের অত লোক নেই। আপনারা পালিয়ে যান।”
আন্তিহারার মাঠের ধান এখন কাটার জন্য তৈরি। কিন্তু কাটবে কে? সকলেই তো পালিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, ত্রাণ শিবির থেকে মানুষ গ্রামে ফেরা শুরু করেছেন। জয়পুর এলাকায় প্রথম সংঘর্ষ ছড়িয়েছিল। সেখানকার কৃষক মহিরুদ্দিনও বলছেন, “সবাই মিলে এত বছর বাস করেছি। কোনও দিন সমস্যা হয়নি। আবার সব স্বাভাবিক হবে কবে?” এই এলাকার উপজাতিরা চাইছেন পুলিশ-আধাসেনারা অভয় দিয়ে সংখ্যালঘু ভাইদের গ্রামে ফিরিয়ে আনুক। জীবন তা হলে ফের নতুন করে শুরু করা যায়। কিন্তু, কারা যেন নাগাড়ে ভয় দেখিয়ে চলেছে। কোকরাঝাড় থেকে চিরাং, বাক্সা সর্বত্রই সেই ‘তৃতীয় কণ্ঠে’র ফিসফিসানি কোনও কিছু স্বাভাবিক হতে দিচ্ছে না। এখান থেকেই পৃথক বড়োভূমির আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পৃথক দেশ মেলেনি, পৃথক রাজ্যও না। মিলেছে স্বায়ত্তশাসিত পরিষদ। ফের পৃথক রাজ্যের জন্য আন্দোলনও শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল স্বায়ত্তশাসিত পরিষদ ভেঙে বড়োভূমিকে অসম সরকারের শাসনাধীনে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এতে আশঙ্কা ছড়াচ্ছে আরও।
রূপসী ব্রহ্ম প্রশ্ন তোলেন, “ফিরে এলে আবার সব আগের মতো হবে তো? পরস্পরের প্রতি যে ভয়, বিতৃষ্ণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা
যাবে তো?”
প্রধানমন্ত্রী ঘুরে গিয়েছেন। তার পরে আজ কোকরাঝাড় ও চিরাং জেলায় নতুন জেলাশাসক নিযোগ করা হয়েছে। আগামী কাল, কোকরাঝাড় আসছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। আবারও হয়তো কিছু আশ্বাস মিলবে। মিলতে পারে ক্ষতিপূরণের ভরসাও। কিন্তু ক্ষতপূরণ যে হওয়ার নয়। জেলা সদর বা সরকার নির্ধারিত দুটি ত্রাণ শিবির ঘুরে মন্ত্রী জানতেও পারবেন না আন্তিহারা, বঁড়শিঝড়া, নাওভিটা, ময়নাগুড়ির যে মানুষগুলো নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে একে অন্যকে পালাবার রাস্তা করে দিয়েছেন, আপাতত তাঁদের একটাই আর্জি, ওই ‘তৃতীয় পক্ষ’টাকে খুঁজে বের করে নিকেশ করা হোক। যাতে, ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষের কলঙ্ক খানিকটা হলেও ঘোচে।
|