মেঘ জমলে বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে, ক্যাচ উঠলে আউট হওয়ার, পেনাল্টি পেলে গোল করার আশা জাগে। ঠিক তেমনই লগ্নির বাজারেও এমন অনেক ঘটনা আছে, যা ঘটলে বা না-ঘটলে তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য ঘটনা ঘটা বা না-ঘটার সম্ভাবনা থাকে। এই কার্যকারণ সম্পর্কে যাঁদের ভাল অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা অতীত এবং বর্তমান দেখে চরম অনিশ্চয়তার বাজারেও অনেকটা সফল ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। সঞ্চয় ও লগ্নির বাজারে কী হলে কী হতে পারে তাই নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
• শুরু করা যাক মেঘ ও বৃষ্টি দিয়ে। এ বার মেঘের আনাগোনায় কোনও ঘাটতি না থাকলেও বর্ষার উদ্দেশে বলতেই হচ্ছে, ‘তোমার দেখা নাই রে, তোমার দেখা নাই’। অতিবৃষ্টি এবং অনাবৃষ্টি দুই-ই অত্যন্ত খারাপ ভারতীয় কৃষি, শিল্প, শেয়ার বাজার এবং অর্থনীতির পক্ষে। এ বারের বর্ষার মরসুমে কোনও কোনও অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ হলেও বৃষ্টি-স্বল্পতায় ভুগছে প্রায় গোটা ভারত। বৃষ্টিতে ভাল রকম ঘাটতি থাকলে যা যা হতে পারে তার মধ্যে থাকবে
(১) কৃষি উৎপাদন কমার ফলে খাদ্য সামগ্রীর আরও চড়া দাম।
(২) চাষির আয় কমলে দুর্বল হতে পারে গ্রামীণ অর্থনীতি, কমতে পারে শিল্পপণ্যের চাহিদা। শুধু তেল সাবান নয়, চাহিদা কমতে পারে মোটর বাইক এমনকী গাড়িরও। ফলে চিন্তায় আছে এই সব পণ্য প্রস্তুতকারী সংস্থা। আশঙ্কায় শেয়ার বাজারও।
(৩) কম বৃষ্টির প্রভাব পড়তে পারে কৃষি-নির্ভর শিল্পেও। যেমন চা, কফি, চিনি, সার ইত্যাদি।
(৪) খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন কম হলে ওই সব পণ্যের আমদানি বাড়বে, ফলে বাড়বে ডলারের চাহিদা। আরও কমতে পারে টাকার দাম। বাড়বে ভর্তুকির বোঝা।
(৫) খাদ্য সামগ্রীর দর আকাশছোঁয়া হলে বাড়বে সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধির হার। ফলে চড়াই থাকবে সুদের হার। মার খাবে শিল্প। ম্লান থাকবে শেয়ার বাজার।
(৬) পড়তে পারে সোনার দাম। কারণ, গরিব চাষিরা সোনা বিক্রি করবেন এবং ধনী চাষিরা কম আয়ের আশঙ্কায় সোনায় লগ্নি কমিয়ে দেবেন।
• আসা যাক সুদ, শিল্প এবং শেয়ার বাজারের কথায়। মূল্যবৃদ্ধির হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ঋণ ও জমার উপর সুদের হার বাড়াতে হয়।
সুদ বাড়লে
(১) শিল্পে উৎপাদন খরচ বাড়ে। ফলে বাড়ে শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের দাম। এতে চাহিদা হ্রাস পায়। কমে উৎপাদন, কমে কর্মসংস্থান। এই রকম একটি পরিস্থিতি চলছে ভারতে। শিল্পে এখন মন্থরতা স্পষ্ট। নেমে আসছে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার।
(২) সুদ বাড়লে আমানতের উপর সুদ বাড়ে। বাজারে বন্ডের দাম কমে। শেয়ার বাজার থেকে লগ্নির একাংশ সরে যায় নিশ্চিত আয় প্রকল্পে। ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ব্যাঙ্ক এবং ঋণ-নির্ভর কোম্পানির শেয়ার দুর্বল হয়। ঋণের উপর সুদ বাড়লে চাহিদা কমে বাড়ি, গাড়ি এবং মোটর বাইকের। যে সব শিল্পে এর ফলে আঘাত আসতে পারে, তার মধ্যে থাকবে ইস্পাত, সিমেন্ট, টায়ার, রং, যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, পাখা, এসি-সহ অনেক ছোট-বড় শিল্প। সুদ কমলে উল্টে যেতে পারে চিত্রটা। তাতে অবশ্য আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে মূল্যবৃদ্ধির হার।
• নগদ জমার অনুপাত বা সি আর আর বাড়লে বাজারে টাকার জোগান কমে। সি আর আর কমলে বাড়ে টাকার জোগান।
• ইউরোপ এবং মার্কিন মুলুকে বেশি ঠান্ডা পড়লে তেলের চাহিদা বাড়ে। এর জেরে বাড়তে পারে অশোধিত তেলের দাম।
• রফতানি কমলে, আমদানি বাড়লে এবং বিদেশি লগ্নি কমলে ডলারের আগমন কমে। ফলে ডলারের দাম বাড়ে। পড়ে টাকার দাম। এতে সুবিধা হয় রফতানিকারী সংস্থার। সঙ্কটে পড়ে আমদানি-নির্ভর শিল্প।
• ডলারের দাম বাড়লে বিদেশে পড়ার খরচ বাড়ে। বাড়ে বিদেশ ভ্রমণের খরচ। টাকার দাম কমলে সস্তা হয় ভারত ভ্রমণের খরচ। সম্ভাবনা থাকে বিদেশ থেকে বেশি পর্যটক আসার। লাভ হয় পর্যটন শিল্পের।
• শেয়ার বাজার তেজী থাকলে উজ্জীবিত হয় নতুন ইস্যুর বাজার। এতে শিল্পে লগ্নি বাড়ে। গড়ে ওঠে নতুন শিল্প। চাহিদা বাড়ে মূলধনী পণ্যের। বাড়ে কর্মসংস্থান। অর্থাৎ বর্তমান পরিকাঠামোয় দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য শেয়ার বাজার তেজী থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। বড় কোম্পানিগুলি যথেষ্ট সাফল্য পেলে তা আকর্ষণ করে বিদেশি লগ্নি। এতে ডলারের আমদানি হয় ভাল রকম। ফলে দাম বাড়ে টাকার।
• ভাল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণে সমৃদ্ধ হয় শেয়ার বাজার। আকৃষ্ট হন বহু নতুন লগ্নিকারী। কোম্পানিগুলিরও দায়িত্ব বাড়ে অসংখ্য নতুন শেয়ারহোল্ডারের প্রতি। পরিণামে এদের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক ব্যাঙ্কের বিলগ্নিকরণের পরে এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।
• বেসরকারি সংস্থায় বাজারের তুলনায় অনেক বেশি সুদের হাতছানি থাকলে তার সঙ্গে বড় মাপের ঝুঁকিও থাকবে, এ কথা মাথায় রাখতে হবে। বাজারে নথিবদ্ধ নয় এমন বেসরকারি সংস্থার ডিবেঞ্চার, বন্ড, প্রেফারেন্স শেয়ার ইত্যাদি কেনার ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধানে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। |