নবদ্বীপের পশ্চিম প্রান্তে গঙ্গানগরে বছর দশেক আগেও নজরে পড়ত কেবল কিছু ঝুপড়ি, ভাঙাচোরা কয়েকটা বাড়ি। এবড়োখেবড়ো রাস্তার দু’পাশে ঝোপঝাড়। এখন ৮ ফুট চওড়া রাস্তার দু’পাশে অধিকাংশই পাকা বাড়ি। কোনওটা দোতলা। কোনও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মোটরসাইকেলও।
কী করে সম্ভব হল এই পরিবতর্ন? এই পাড়ার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন কয়েকটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর জন্যই শ্রী ফিরেছে এলাকার। তাঁদের কথায়, এই এলাকার তৎকালীন কাউন্সিলর তৃণমূলের প্রয়াত তাপস মজুমদারই সেই ২০০৩ সালে দুঃস্থ পরিবারগুলিকে এক এক করে স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে নিয়ে আসেন। এলাকার বাসিন্দা ছবি সাহা বলেন, “তাপসদা আমাদের বলেছিল মাসে ১০ বা ২০ টাকা করে গোষ্ঠীর তহবিলে জমাতে। ছ’মাস পরেই আমরা সেখান থেকে সামান্য কিছু করে টাকা ঋণ পেতে শুরু করি। সেই ঋণ শোধ করলে, আবার বড় টাকার ঋণ পেয়েছি। এই ভাবেই আমাদের ব্যবসার শুরু।” বীরেন সাহা বলেন, “আসলে খুব ছোট ব্যবসা করতে চাইলেও সামান্য একটু মূলধন তো লাগে। সেটা তখন আমাদের কেউ দিত না। কারণ বন্ধক রাখার মতো কিছু আমাদের ছিল না। ওই স্বনির্ভর গোষ্ঠীই আমাদের কাউকে হাজার, কাউকে পাঁচ হাজার করে ঋণ দিয়েছে সামান্য জমা টাকার বিনিময়ে।”
রঞ্জিত পালের কথায়, “ঋণের প্রতিটি পয়সা হিসেব করে খরচা করেছি তখন। তাতেই একটু একটু সাফল্য এসেছে।”
রঞ্জিতবাবু কলকাতায় একটি রিকশা তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। তাঁর স্ত্রী সুনীতা পাল তাপসবাবুর কথায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে কয়েক মাস পরে পাঁচ হাজার টাকা ধার পান। রঞ্জিতবাবু বলেন, “ওই টাকায় খুব প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্রপাতি কিনে বাড়িতে বসেই কাঠ দিয়ে রিকশার আসন তৈরি করা শুরু করি। কাঁচা মালও অবশ্য পেয়েছিলাম ধারে। এখন মাসে গড়ে আশিটা রিকশার আসন তৈরি করি।”
বীরেনবাবু ছিলেন রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী থেকে ধার পেয়ে প্রথমে ঘুরে ঘুরে চপ বিক্রি করা শুরু করেন। সেই ধার শোধ করে আর একটু বেশি টাকা ঋণ পেয়ে শুরু করে দেন মুদিখানার দোকান। ছবিদেবী ঋণের টাকা এখন ঢেলেছেন রেডিমেড পোশাকের ব্যবসায়। এঁদেরই প্রতিবেশী প্রতিমা ও মণীষ ভট্টাচার্যও একই ভাবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পরিবহণের ব্যবসায় নামেন। মণীষবাবু এখন সাতটা রিকশা, একটি মোটর ভ্যান। রাধারানি সাহা টাকা ধার পেয়ে একটি উলের পোশাক বোনার যন্ত্র কিনেছেন। সঞ্চিতা সিংহ ও শম্ভু সিংহ ঋণ পেয়ে কাঁচা বাঁশ বিক্রির ব্যবসায় নামেন। তাঁদেরও এখন পাকা বাড়ি। পুরনো ধার শোধ করে ফের নতুন ঋণ নিয়ে বড় ব্যবসায় নামার কথা ভাবছেন তাঁরা।
তাঁরা প্রত্যেকেই অবশ্য বলেন, তাপসবাবুর ঋণ কোনওদিনই শোধ হবে না। ছবিদেবীর কথায়, “কে কত টাকায় কী ব্যবসা শুরু করতে পারেন, তার বুদ্ধিও তাপসদাই দিতেন।” নবদ্বীপের পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহাও বলেন, “তাপসবাবুর জন্যই স্বনির্ভর গোষ্ঠী ওই এলাকায় খুবই সফল। স্বর্ণজয়ন্তী শহরী রোজগার যোজনায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি সামান্য কিছু টাকা জমাতে পারলেই, তার সদস্যেরা অনেক টাকা করে ঋণ পেতে পারেন। ডাকুয়া গোষ্ঠীতে ঋণের পরিমাণ আরও বাড়ানো যায়। সেই সুযোগটা এউ এলাকার বাসিন্দারা পেয়েছেন। অন্যরাও এগিয়ে আসুন।” এই প্রকল্পের এক সক্রিয় কর্মী কাকলি রায়ের কথায়, “এই পরিবারগুলিও প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছে। তাঁদের দেখেই আরও অনেকে এখন এই প্রকল্পে যোগ দিতে আগ্রহী হয়েছেন”
বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি। নিজের ঘরে সোফায় বসে সুনীতাদেবী বললেন, “সেই সময়ে বর্ষা ছিল বিভীষিকা। ঝুপড়ির ত্রিপল ফুটো করে জল পড়ত। আশ্রয় নিতে হত কোনও পাকা বাড়ির বারান্দায়। এখন বর্ষায় আমাদের বাড়ির বারান্দায় কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে তাঁকে ঘরে এসে বসতে বলি।” |