ভাড়া বাড়ানোর মতো ‘কঠোর’ সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ রাজ্য সরকার। অথচ তার জেরে একের পর এক বাস-ট্যাক্সি বন্ধ হয়ে তীব্র হচ্ছে পরিবহণের সঙ্কট। জনমোহিনী রাজনীতি এবং অর্থনীতির এই দ্বন্দ্ব থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজতে সোমবার চার সদস্যের মন্ত্রিগোষ্ঠী তৈরি করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিটিতে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র ছাড়াও থাকছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত।
এ দিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই বাস, মিনিবাস এবং ট্যাক্সি ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন পরিবহণমন্ত্রী। সংগঠনগুলির নেতারা মন্ত্রীকে জানিয়ে দেন, তাঁরা ভাড়া বৃদ্ধির দাবি থেকে সরছেন না। মন্ত্রীও পাল্টা জানান, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই পরিবহণ সমস্যার সমাধানসূত্র বের হয়নি। বৈঠক-শেষে বাস মালিকেরা জানিয়ে দেন, ৩১ জুলাই তাঁদের ধর্মঘট হচ্ছে-ই। শুধু রমজান মাস চলায় দু’দিনের পরিবর্তে ২৫ জুলাই, বুধবার এক দিনই ধর্মঘটে যাচ্ছে ট্যাক্সি সংগঠনগুলি। |
শুধু বেসরকারি পরিবহণ নয়, মুখ্যমন্ত্রী ভাড়া না বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় বিপাকে পড়েছে সরকারি পরিবহণ সংস্থাগুলিও। ছ’মাস আগে সরকারি পরিবহণকে লাভজনক করার বিকল্প রাস্তা তৈরির কথা ঘোষণা করেছিল সরকার। কিন্তু এত দিনেও সে সম্পর্কেও নির্দিষ্ট কোনও রূপরেখা দিতে পারেননি পরিবহণমন্ত্রী। মহাকরণ সূত্রের খবর, এই পরিস্থিতি সামাল দিতেই এ দিন মন্ত্রিগোষ্ঠী তৈরি করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও বিদ্যুৎমন্ত্রী বলেন, “পরিবহণ দফতরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প খতিয়ে দেখার জন্য প্রাথমিক ভাবে বলা হয়েছে।”
সরকারের সঙ্গে এ দিনের বৈঠক নিয়ে স্পষ্টতই হতাশ পরিবহণ সংগঠনগুলি। সিটু প্রভাবিত অল ইন্ডিয়া রোড ট্রান্সপোর্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই বৈঠকের অর্থ কী, সেটাই বুঝতে পারছি না। মন্ত্রী গোড়াতেই জানিয়ে দিলেন, ভাড়া বাড়বে না। সরকার যদি ভাড়া না বাড়ায়, তা হলে ভর্তুকি দিক।” এ ব্যাপারে বাম আমলে জ্বালানির উপরে বাস মালিকদের ভর্তুকি দেওয়ার প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
ঘটনা হল, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত বাস মালিকদের ডিজেলে লিটার-পিছু দু’টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেও প্রক্রিয়াগত জটিলতার জন্য তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে এ বারও সরকার ভর্তুকি দিতে চাইলেও তা কার্যকর করা যাবে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অবশ্য তার থেকেও বড় প্রশ্ন হল, সরকারি কোষাগারের যখন বেহাল দশা, তখন ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হবে কী ভাবে? সুভাষবাবুর অবশ্য দাবি, “সরকারের টাকা নেই, এ সব বাজে কথা। তা ছাড়া, কিছু তো একটা সরকারকে করতে হবে। পরিবহণ শিল্পের সঙ্গে বহু মানুষের জীবিকা জড়িয়ে রয়েছে। সরকারের একগুঁয়েমির কারণে সেটা তো শেষ হয়ে যেতে পারে না।” তিনি জানান, ৩১ জুলাই রানি রাসমণি রোডে সব পরিবহণ সংস্থার কর্মীরা সকাল ১০টা থেকে ধর্নায় বসবেন। পরে রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপিও দেবেন তাঁরা।
বাস মালিকদের সংগঠন জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেট-ও এ দিন জানিয়ে দেয়, ৩১ তারিখ বন্ধের ডাক থেকে তারা সরছে না। সংগঠনের সম্পাদক সাধন দাস বলেন, “২০১০ সাল থেকে সাত দফায় ডিজেলের দাম বেড়েছে। কিন্তু ভাড়া বাড়ছে না। রোজগার না হলে বাস চালাব কেন?” ৩১ জুলাইয়ের ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছে মালিকদের আর একটি সংগঠন বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটও। সংগঠনের সহ সভাপতি দীপক সরকারের কথায়, “মন্ত্রী মূল সমস্যা এড়িয়ে যাচ্ছেন। এ ভাবে আর বাস চালানো যাবে না।” তবে ধর্মঘটে সামিল না হলেও আন্দোলন চলবে বলে জানিয়ে দিয়েছে মিনিবাস অপারেটার্স কো-অর্ডিনেশন কমিটি। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অবশেষ দাঁ জানান, অগস্টের প্রথম সপ্তাহে তাঁরা ভুখা মিছিল করবেন। তিনি বলেন, “ভাড়া না বাড়িয়ে বিকল্প রোজগারের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছিল এক বছর আগে। কিন্তু তার কিছুই হয়নি।”
চলতি মাসের ২৫ ও ২৬ তারিখ ট্যাক্সি ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন। বৈঠকের পরে সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যা পরিস্থিতি তাতে ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘটের কথা ভাবা হচ্ছে। সংগঠনের তরফে বিমল গুহ বলেন, “কলকাতায় সাত-আট হাজার ট্যাক্সি কম চলছে। তা সত্ত্বেও ভাড়া বাড়ানো যাচ্ছে না। তার উপরে পুলিশি জুলুম এবং লাইসেন্স নবীকরণ নিয়ে হয়রানি তো আছেই।” বিকেলে নিজেদের মধ্যে বৈঠকের পরে অবশ্য রমজান মাসের কারণ দেখিয়ে ধর্মঘটের মেয়াদ ২৪ ঘণ্টা করেন তাঁরা। |