ধ্যানের অপরিসীম শক্তি ও সম্ভাবনার কথা লিখে গিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। কে জানত, তাঁরই সার্ধশতবর্ষে ‘মেডিটেশন’ বা ধ্যানকে সম্বল করে আভিজাত্যে বিশ্বের কুলীনতম গল্ফ টুর্নামেন্টে বিরলতম ‘হোল ইন ওয়ান’ করে দেখাবেন এক বঙ্গসন্তান? সোমবার রাতে দুবাই বিমানবন্দরে যখন তাঁকে ধরা গেল, অভিনন্দন জানাতেই প্রতিক্রিয়া, “আরে না না। এখনও তেমন কিছু করিনি। সবে তো শুরু।”
সদ্য শেষ হওয়া ব্রিটিশ ওপেনে অনির্বাণ লাহিড়ির চমকপ্রদ সাফল্যের রসায়ন খুঁজতে গিয়ে অবধারিত ভাবে উঠে আসছে ইরেজি ‘মেডিটেশন’ শব্দটা। মনোসংযোগ বা একাগ্রতা বাড়াতে আধুনিক খেলাধুলোয় ‘মেডিটেশন’-এর সাহায্য নেওয়া বহুলপ্রচলিত। কিন্তু ‘সলিটিউড ক্যাম্প’ বা নীরবতার শিবির? যেখানে কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না আপনি, কথা বলা একেবারে নৈব নৈব চ, বহিজর্গতের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকতে হবে প্রকৃতির সংশ্রবে। কোনও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদ বড় টুর্নামেন্টে সাফল্যের জন্য নীরবতা শিবিরে নাম লিখিয়ে প্রস্তুতি সেরেছেন, কে কবে শুনেছে? |
ব্রিটিশ ওপেনে যোগ্যতা অর্জনের পরে ব্যক্তিগত কোচ বিজয় দিবেচাকে নিয়ে শুধু লিথ্যামের কোর্সই ঘুরে আসেননি অনির্বাণ, নাম লিখিয়েছিলেন এক ‘সলিটিউড ক্যাম্প’-এ। যেখানে টানা দশদিন কারও সঙ্গে কথা না বলে কাটিয়েছেন। উদ্দেশ্য ধ্যানের মাধ্যমে অন্তরের শক্তি ও মনের চূড়ান্ত প্রশান্তি খুঁজে সেটা নিজের গল্ফে কাজে লাগানো। বহির্বিশ্ব এবং কোর্সে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক ঘটনা থেকে মনকে সরিয়ে রাখার জন্যই প্রতিদিন টি-অফের আগে কুড়ি মিনিটের ধ্যান অনির্বাণের গল্ফে বাধ্যতামূলক। যা মনকে পুরো চিন্তাশূন্য করে দেয় এবং এই অবস্থাটা ১৮টা ‘হোল’ ধরে রেখে যাওয়া একটা পদ্ধতি। ধ্যানের সাহায্যে যা ধীরে ধীরে রপ্ত করার নিরন্তর চেষ্টাই যে তাঁর পাখির চোখ, ব্রিটিশ ওপেন শুরুর আগে প্রচারমাধ্যমকে বলেছিলেন ২৫ বছরের ভারতীয় তরুণ।
দ্রাবিড়ের শহরের ছেলের কাছে ধ্যান অবশ্যই আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত আর সেটা বলছে তাঁর পারফরম্যান্স। এত বড় টুর্নামেন্টে অভিষেকেই এশীয়দের মধ্যে এ বছর সেরা পারফরম্যান্স (৩১ নম্বর)। ১৪১ বছরের টুর্নামেন্টে সর্বকালের সেরা ভারতীয় নজির জ্যোতি রণধাওয়ার (২৭ নম্বর), ২০০৪-এ। সেটাও প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিলেন অনির্বাণ। যা নিয়ে জ্যোতি রণধাওয়ার গলাতেই উচ্ছ্বাস। সোমবার ফোনে বললেন, “আবির্ভাবে এই পারফরম্যান্স অভাবনীয়। অবিশ্বাস্য। ভারতীয় গল্ফ নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখানোর মতো রসদ এই ছেলেটার আছে।” |
এক কথায় ব্রিটিশ ওপেনে ধূমকেতুসদৃশ উত্থান অনির্বাণের আর এতে ভারতীয় গল্ফের দুনিয়া এতটাই চমকিত ও আবেগাপ্লুত যে কেউ কেউ দ্রাবিড়ের শহর থেকে ‘গল্ফের দ্রাবিড়’ উঠে আসার সম্ভাবনা খুঁজে পাচ্ছেন। অভিভুত হওয়ার পারদ এতটাই উর্ধ্বমুখী যে শুধু দ্রাবিড় কেন, তাঁকে ছাপিয়ে গল্ফের সচিনকেও খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে।
পারফরম্যান্সের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে সাতের দশকে লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট আবির্ভাবে সবুজ উইকেটে লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরির তুলনা টানলে বাড়াবাড়ির দায়ে পড়তে হবে না। অথচ পাক্কা পেশাদারের মতো ব্রিটিশ ওপেন নিয়ে উদ্ভূত আবেগকে পিছনে সরিয়ে রাখছেন বঙ্গসন্তান। টাইগার উডসে মজে থাকা তরুণের আবেগের বহির্প্রকাশ বলতে ‘হোল ইন ওয়ান’ করা বলটা বাবা ডাক্তার কর্নেল তুষার লাহিড়ির হাতে তুলে দেওয়া। ঘটনার সাক্ষী থাকা ভারতের পেশাদার গল্ফ সংস্থার (পিজিটিআই) ডিরেক্টর পদমজিৎ সাঁধু লন্ডন থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে বলছিলেন, “ওই একবারই ওকে আবেগে ভাসতে দেখেছি। সবচেয়ে বড় কথা, ও নিজে মনে করছে, এটাই শেষ নয়। ওর আরও অনেক কিছু করার আছে।” “পেশাদার গল্ফ হল এমন একটা খেলা, যেখানে আপনি যদি ২০ শতাংশ টুর্নামেন্ট জেতেন, ধরে নিতে হবে আপনিই বিশ্বসেরা,” বলেছিলেন প্রবাদপ্রতিম জ্যাক নিকোলাস। নির্যাস হল, এখানে পারফরম্যান্সের গ্রাফের ওঠানামা এতটাই রঙ বদল করে যে টেনিসের মতো টানা সপ্তাহের পর সপ্তাহ কারও এক নম্বর থেকে যাওয়াটা অলৌকিকের মতো ব্যাপার। যে কারণে ব্রিটিশ ওপেনে ৩১ নম্বর হওয়াটা অনির্বাণের কাছে খুব দ্রুত অতীত হয়ে যাওয়া উচিত বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। |