জলেও খরা রুপোলি শস্যের, ইলিশের
টান সামাল দিতে গঙ্গা-পদ্মা একাকার
সাকুল্যে দু’শো কেজি এসেছিল বাংলাদেশ থেকে। এক একটার ওজন বড়জোর সাতশো-ন’শো গ্রাম। শনিবার হাওড়া মাছ-বাজারে তা নিলাম হল ৮৪০ টাকা কেজি দরে। খুচরো বাজারে বিকোবে অন্তত হাজার টাকায়!
গত ক’বছরে দাম কখনও এত চড়েনি! ইলিশ ক্রমশ ডোডোপাখি হয়ে যাচ্ছে নাকি?
ভরা মরসুমে প্রশ্নটা ঘোরাফেরা করছে সব মহলে। ভোজনরসিক বাঙালির রসনাতৃপ্তির এই মস্ত উপাদানটি দিন দিন দুর্লভ হয়ে উঠছে। এতটাই যে, বিষয়টি নিয়ে মত ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য আজ, মঙ্গলবার কলকাতায় এক সঙ্গে বসছেন ভারত ও বাংলাদেশের নদী-মৎস্যবিজ্ঞানীরা। ইলিশ-সঙ্কট মোকাবিলায় এ-পার ও-পারের এ হেন যৌথ উদ্যোগ এই প্রথম। সঙ্কটের ছবিটা কী রকম?
নথি বলছে, ২০১০-এ পশ্চিমবঙ্গে ৫০ হাজার টন ইলিশ ধরা হয়েছিল। ২০১১-এ মেরেকেটে ১৬ হাজার। এ বছর এখনও নগণ্য। যে বাংলাদেশের সৌজন্যে গত ক’বছর চাহিদা খানিকটা সামাল দেওয়া গিয়েছিল, সেখানেও টান। রাজ্যের মাছ আমদানিকারীদের সংগঠন ‘ফিশ ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি অতুল দাসের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-এ বাংলাদেশি ইলিশ এসেছিল ৭ হাজার টন, ২০১১-য় প্রায় ৬ হাজার। এ বছরের আমদানি এখনও দু’শো টনে পৌঁছয়নি। “ওরা নিজেদের বাজারেই মাছ জোগাতে পারছে না, রফতানি করবে কী?” বলছেন অতুলবাবু।
মায়ানমারে ইরাবতীর মোহনায় ধরা কিছু ইলিশও অবশ্য বাংলাদেশ মারফত কলকাতার বাজারে চালান হয়। যদিও আমদানির পরিমাণ সামান্য। তা ছাড়া আকারে বড় হলেও স্বাদের নিরিখে তা গঙ্গা-পদ্মার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। আকালের বাজারে ইরাবতীর সেই ‘কম স্বাদের’ ইলিশই বাঙালির রসনার ভরসা হয়ে উঠবে কি না, সেই প্রশ্নও এখন দেখা দিয়েছে।
ইলিশের এমন আকাল কেন?
অভিজ্ঞ মৎস্যজীবীদের মতে, বৃষ্টি আর পুবালি বাতাসের যুগলবন্দিতে সাধারণত ইলিশ ওঠে। কিন্তু এ বার পুবের বাতাস বইলেও বৃষ্টি হয়নি। বিজ্ঞানীরা অবশ্য এই তত্ত্বকে তেমন আমল দিচ্ছেন না। তাঁদের দাবি, বৃষ্টির অপ্রতুলতার পাশাপাশি আরও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন?
বিজ্ঞানীমহলের ব্যাখ্যা: দূষণের জের তো আছেই। গঙ্গার মোহনায় ও সমুদ্রে অজস্র ট্রলারও বল্গাহীন ভাবে ইলিশ-শিকার করছে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ৯০ মিলিমিটারের (সাড়ে তিন ইঞ্চি) ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে দেদার ‘খোকা ইলিশ’ ধরা হচ্ছে। অথচ ছোট অবস্থায় ইলিশ ধরে ফেললে এক দিকে ভবিষ্যতে বড় মাছ মেলার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়, অন্য দিকে ইলিশের বংশবৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। উপরন্তু নদী এবং মোহনাঘেঁষা সমুদ্রের গভীরতা কমে যাওয়াও সঙ্কটের বড় কারণ। কেন?
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ইলিশের পরিযাণের জন্য তার চলার পথ অন্তত চল্লিশ ফুট গভীর হতে হবে। জলের প্রবাহ কমায় তার স্বাভাবিক বিচরণ বাধা পাচ্ছে। তাই ইলিশ হামেশা বাধ্য হচ্ছে মোহনায় ডিম পাড়তে, যা স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী। এতে ইলিশের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। স্বাদও কমছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা: সমুদ্রের নোনা জল থেকে মাছ যত নদীর উজানে যেতে থাকে, তত তার শরীর থেকে ঝরতে থাকে আয়োডিন, লবণ ইত্যাদি। পরিযাণের সময়টায় সে কিছু খায়ও না। তাই ইলিশ যত বেশি মিষ্টি জলে থাকতে পারবে, তত তার দেহ থেকে কমবে লবণ ও বিভিন্ন খনিজ। তত তার স্বাদ বাড়বে। যে কারণে ইরাবতীর মোহনায় ধরা ইলিশের চেয়ে গঙ্গা-পদ্মার ইলিশ খেতে ভাল। অনুকূল পরিবেশ ও খাদ্যের তারতম্যেও ইলিশের স্বাদ বদলায়। কিন্তু ইদানীং বিচরণপথে নানাবিধ বাধার দরুণ ইলিশের পরিমাণ ও গুণমান দুই-ই মার খাচ্ছে।
অতএব নদীর নাব্যতা বাড়ানোর কথা বলছেন বিশেষজ্ঞেরা। সঙ্গে চাইছেন যথেচ্ছ ইলিশ-শিকারে নিষেধাজ্ঞা। নচেৎ ইলিশ সত্যিই ‘বিপন্ন’ মাছের তালিকায় চলে যাবে বলে ওঁদের আশঙ্কা। সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিআইএফআরআই)-এর নদী-মৎস্যবিভাগের প্রধান তথা ইলিশ-বিশেষজ্ঞ উৎপল ভৌমিকের কথায়, “বাঙালির পাতে ইলিশ ফেরাতে গেলে এখনই মাছ ধরায় কড়া নিয়ন্ত্রণ জরুরি।” তাঁর বক্তব্য: গভীর সমুদ্র থেকে গঙ্গা উজিয়ে ফরাক্কার দিকে আসার পথে ইলিশের ঝাঁক ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটায় মোটামুটি তিনটে জায়গায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়চক, হুগলির ত্রিবেণী ও মুর্শিদাবাদের লালবাগ। ইলিশের সুষ্ঠু প্রজননের স্বার্থে সেখানে চিহ্নিত স্থানের দশ কিলোমিটারের মধ্যে বিজয়া দশমীর (অক্টোবর-নভেম্বর) পর থেকে ১৫ দিন মাছ ধরা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার উপর জোর দিচ্ছেন উৎপলবাবু। তাঁর সুপারিশ: সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ও ফেব্রুয়ারি-মার্চে যখন নোনা জল থেকে ইলিশের ঝাঁক নদীতে ঢোকে, তখনও মোহনার কাছে পূর্ণিমা-অমাবস্যায় অন্তত পাঁচ দিন করে মাছ ধরা বন্ধ থাকুক। “দরকারে মৎস্যজীবীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সমুদ্র থেকে ইলিশ যদি নদীতে ঢুকে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটাতে না-পারে, আর সেই বাচ্চা যদি ৩-৪ ইঞ্চি বেড়ে সমুদ্রে ফিরতে না-পারে, তা হলে বড় ইলিশ মিলবে কী করে?” প্রশ্ন তাঁর।
পাশাপাশি ছোট ফাঁসের জালও সমস্যা ঘনীভূত করে তুলছে বলে মনে করছেন ওঁরা। উৎপলবাবুর অভিযোগ: কিছু মৎস্যজীবী ‘প্রায় মশারির মতো’ ছোট ফুটোর ফানেলাকৃতি জাল (বিনতি জাল) দিয়ে ইলিশের বাচ্চা ধরে খয়রা মাছ বলে বেচছেন। তাঁর দাবি, “মোহনাতেও পাঁচশো কেজি ইলিশ উঠলে দেখা যাচ্ছে, তিনশো কেজিই দেড়শো থেকে তিনশো গ্রামের। এ সব বন্ধ করতে হবে। না-হলে অদূর ভবিষ্যতে ইলিশের মুখই দেখা যাবে না।” বস্তুত ৫০০ গ্রামের কম ওজনের ইলিশ ধরা, বিক্রি বা খরিদ সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণার সুপারিশ করছেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।
মৎসীজীবীদের অনেকেরও একই মত। যেমন দিঘার মৎস্যজীবী সংগঠন ‘ইউনাইটেড ফিশারমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি প্রণবকুমার কর বলেন, “ছোট ফাঁদের জাল বন্ধ করতে আইন হলেও সরকারি নজরদারি নেই। তা ছাড়া ওড়িশা-অন্ধ্রে থাকলেও এ রাজ্যে ট্রলার বা মাছ ধরার যন্ত্রচালিত নৌকোর রেজিস্ট্রেশনে নিয়ন্ত্রণ নেই। এ ভাবে ট্রলার দাপিয়ে বেড়ালে ইলিশ কেন, কোনও মাছই পাওয়া যাবে না।” মন্তব্য প্রণববাবুর। তাঁর দাবি, পশ্চিমবঙ্গে বছরে পাঁচশোরও বেশি ট্রলার রেজিস্ট্রেশন পাচ্ছে। ইলিশ-সঙ্কট মোকাবিলায় রাজ্যের ব্যর্থতা কার্যত মেনে নিয়ে মৎস্যমন্ত্রী আবু হেনার স্বীকারোক্তি, “আইন থাকলেও নদী বা সমুদ্রে নিরন্তর নজরদারি চালানোর মতো পরিকাঠামো আমাদের নেই। খুচরো-পাইকারি বাজারে অভিযান চালাতে হবে। ট্রলারে নিয়ন্ত্রণও দরকার। দেখা যাক, কী করা যায়।”
ইলিশ-খরার আঁচ লেগেছে বাংলাদেশেও। বরিশালের মৎস্যজীবী কাজি আবদুল মান্নানের আক্ষেপ, “মাছ উঠছে খুব কম। এখানকার বাজারের চাহিদা মিটিয়ে খুব একটা রফতানি করা যাচ্ছে না।” অথচ ইলিশ সংরক্ষণে বাংলাদেশ যথেষ্ট উদ্যোগী। খোকা ইলিশ (জটকা) ধরা ঠেকাতে সেখানে কড়া আইন রয়েছে। পুলিশ-আধা ফৌজ-সরকারি অফিসারদের নিয়ে তৈরি টাস্ক ফোর্স নিয়মিত নদীতে, সমুদ্রে ও বাজারে হানা দিয়ে ছোট ফাঁদের অবৈধ জাল ও ছোট ইলিশ বাজেয়াপ্ত করে থাকে। বাংলাদেশে ইলিশের ডিম পাড়ার পাঁচটি চিহ্নিত জায়গার দশ কিলোমিটারের মধ্যে অক্টোবরের ৬-১৬ তারিখ মাছ ধরা সম্পূর্ণ বন্ধ।
তবু ইলিশের দেখা নেই সে দেশে। ভরা মরসুমে এত কম ইলিশ বাংলাদেশে এই প্রথম। মৎস্য-বিজ্ঞানীদের প্রাথমিক অনুমান, রফতানিকারীদের চাপে গত ক’বছরে অত্যধিক ইলিশ ধরারই পরিণতি এটা। সঙ্কট যে দু’পারেই ঘনিয়ে উঠছে, তা বুঝতে পেরে দুই দেশের বিশেষজ্ঞেরা আজ বসছেন সুরাহার পথ খুঁজতে।
বাঙালির পাতে স্বাদের-সাধের-ঐতিহ্যের ইলিশ ফেরানোর আশা নিয়ে।
মৎস্যপুরাণ
গঙ্গা উজিয়ে যেটা আসে বা একদা আসতো, সেটা ইলিশ— হিলসা। নর্মদা উজিয়ে ঐ মাছই যখন আসে তখন ব্রৌচের লোক এটাকে বলে মদার, পার্সিরা বলে বিম্। সিন্ধু উজলে এই মাছকেই বলে পাল্লা।
পঞ্চতন্ত্র
গঙ্গা-পদ্মার ইলিশের বৈজ্ঞানিক নাম: টেনুয়ালোসা ইলিশা
গুণাগুণ
মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র, চোখের জন্য ইলিশ উপকারী। এর ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদরোগে নিয়ন্ত্রণে কার্যকর।
১০০ গ্রাম ইলিশে থাকে ২২ গ্রাম প্রোটিন, ১৯.৫ গ্রাম ফ্যাট, ১৮০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২৫০ মিলিগ্রাম ফসফরাস।
সবচেয়ে বড়
ওজন: সওয়া ৪ কেজি।
লম্বা: ৬১৪ মিলিমিটার। চওড়া: ১৯৬ মিলিমিটার।
প্রাপ্তিস্থান: গুজরাতের সুরাতে তাপ্তির মোহনা (অগস্ট, ২০১১)।
ডিম ফোটার পর এক বছরে ইলিশ ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। তার পরে
ফি বছরে বাড়ে ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত। এক কেজির বড় হতে অন্তত ৩ বছর।
এমন ছোট ইলিশই জালে পড়ছে হরদম। ফলে ঘনাচ্ছে বিপদ।
সোদপুরের কাছে গঙ্গায়। বিতান ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

পরিযাণ
ডিম পাড়ার সময় ইলিশ গভীর সমুদ্রের নোনা জল থেকে গঙ্গায় ফরাক্কা পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কিমি যায়।
এই যাত্রাই পরিযাণ। বর্ষায় (মে থেকে অক্টোবর) ও শীতে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) ইলিশ ঝাঁক বেঁধে
সমুদ্র থেকে নদীতে ঢোকে। পোনা ৩-৪ ইঞ্চি হওয়ার পরেই সমুদ্রের দিকে ফিরতে শুরু করে।
ফরাক্কা ব্যারাজ হওয়ার আগে ইলিশ গঙ্গায় কানপুর আর যমুনায় আগরা পর্যন্ত যেত।
সুদিন ফেরাতে
জালের ফাঁদ ৪ ইঞ্চির বেশি নয়।
পাঁচশো গ্রামের নীচে ইলিশ ধরা, বিক্রি, কেনা বন্ধ।
ডিম ফোটানোর জায়গার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা।
 



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.