|
|
|
|
চিঠি লিখে পাঁচ মাস নিখোঁজ অসুস্থ কৃতী ছাত্র |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
ক্যানসারে আক্রান্ত সেই মেধাবী সুব্রত বারিক নিখোঁজ। প্রায় পাঁচ মাস ধরে। তার ঘর থেকে মিলেছে দু’টি চিঠি। একটি চিঠিতে সে এক বন্ধুকে লিখেছে, ‘আমার রোগমুক্তির জন্য তোমরা অনেক খেটেছ। আমি তোমাদের মর্যাদা রাখতে পারলাম না।’
সুব্রত ঝাড়গ্রামের কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশনের একাদশ শ্রেণির কৃতী পড়ুয়া। সে অস্থির ক্যানসারে (অস্টিওসারকোমা) আক্রান্ত। এ বছর ১৬ এপ্রিল মুম্বইয়ের হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হওয়ারও কথা ছিল। সে জন্য
|
সুব্রত বারিক |
সহপাঠী-শিক্ষকেরা পথে নেমে অর্থ সংগ্রহও করছিলেন। কিন্তু তার আগেই, গত ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে স্কুল হস্টেল থেকে স্টেশনে যাওয়ার নাম করে সেই যে সে বেরিয়ে যায়, আর খোঁজ মেলেনি। অসুস্থতার কারণে পড়াশোনায় পিছিয়ে যাচ্ছে, এমন একটা ধারণার বশবর্তী হয়েই কৃতী ছাত্রটি নিখোঁজ হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁর শিক্ষক এবং পরিজনেরা।
২০ ফেব্রুয়ারিই ঝাড়গ্রাম থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনুপ দে। ছাত্রটির পরিবারের পক্ষ থেকেও থানায় জানানো হয়। সংবাদপত্রে সুব্রতর ছবি-সহ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে সিআইডি। ছাত্রটির মোবাইল ফোনের টাওয়ারের অবস্থানের সূত্রে নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জ ও উত্তরবঙ্গের গোয়ালপোখরের মতো কয়েকটি জায়গায় গিয়েও তার খোঁজ পায়নি পুলিশ। পুলিশের বক্তব্য, নিখোঁজ হওয়ার পরে সপ্তাহ দু’য়েক পর্যন্ত সুব্রত মোবাইল ফোন ব্যবহার করলেও, পরে আর সিমের ব্যবহার ধরা পড়েনি।
নিখোঁজ ছাত্রটির বাড়ি ঝাড়গ্রামেরই বাঁধগোড়া অঞ্চলের নেকড়াশুলি গ্রামে। তার বাবা নিতাইবাবু সামান্য সব্জি-বিক্রেতা। মা রঙ্গলতাদেবী গৃহবধূ। একমাত্র ছেলে নিখোঁজ হওয়ায় বারিক দম্পতি দিশেহারা। গত বছর বাঁধগোড়ার হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল ফল করে কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশনে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়েছিল সুব্রত। তার আগেই ক্যানসার ধরা পড়েছিল। অভাবের সংসারে ছেলের উপযুক্ত চিকিৎসাও করাতে পারছিলেন না নিতাইবাবু। কুমুদকুমারীতে সুব্রতের সহপাঠী আর শিক্ষকেরাই সব জেনে তার চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পথে নামেন। গত অক্টোবরে মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা শুরুও হয়। সেখান থেকে ফিরে গত নভেম্বরে ষাণ্মাসিক পরীক্ষাও দেয় সুব্রত। প্রধান শিক্ষক অনুপ দে-র কথায়, “ষাণ্মাসিক পরীক্ষার পরে ক্লাসে অনিয়মিত আসত সুব্রত। হস্টেলের ঘরেই চুপচাপ থাকত। বার্ষিক পরীক্ষার মাস খানেক আগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি স্টেশনে যাওয়ার নাম করে হস্টেল থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি।”
অনুপবাবু জানান, সুব্রতের অসুস্থতার জন্য সংগৃহীত আড়াই লাখেরও বেশি টাকা এখনও রয়েছে তার অ্যাকাউন্টে। ব্যাঙ্কের পাসবই এবং এটিএম কার্ডও হস্টেলের ঘরেই রেখে গিয়েছে সুব্রত। সহপাঠী শুভঙ্কর বালাকে সুব্রত লিখেছে, “আমার রোগমুক্তির জন্য তোমরা অনেক খেটেছ, কিন্তু আমি তোমাদের মর্যাদা রাখতে পারলাম না।” ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা কোনও ক্যানসার-আক্রান্তের চিকিৎসার জন্য খরচ করার কথাও লিখে গিয়েছে ওই ছাত্র। এ ভাবে ‘চিরবিদায়’ নেওয়ার জন্য স্কুলের ইংরাজির শিক্ষক প্রদ্যোৎ দাসকে লেখা চিঠিতে ক্ষমাও চেয়েছে সুব্রত। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া প্রদ্যোৎবাবু বলেন, “অসুস্থতার জন্য পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছিল। আমরা চেয়েছিলাম, ও আগে সুস্থ হোক। কিন্তু তার আগেই অভিমান করে কোথায় চলে গেল ছেলেটা।” রঙ্গলতাদেবী ও নিতাইবাবুর প্রশ্ন, “সুব্রত যদি ফিরে না আসে তা হলে আমরা আর কার জন্য বাঁচব?”
বিমর্ষ সহপাঠীদের কথায়, “সুব্রত নিজে হারিয়ে গিয়ে ওর অসুস্থতার বিরুদ্ধে আমাদেরও লড়াইটাকেও যে হারিয়ে দিয়ে গেল!”
|
|
|
|
|
|